স্মরণঃ নীতি ও চরিত্রের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকুন –মমিনুল ইসলাম মোল্লা

২৩ আগস্ট অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের মৃত্যু বার্ষিকী । দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মোজাফ্ফর আহমেদ কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদে ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যা সংক্ষেপে ন্যাপ নামে পরিচিত। এদলটির নেতৃত্ব দেন বর্ষিয়ান নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করার পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজে ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু শিক্ষকতা পেশা তাকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারে নি। তিনি শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতি জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেেেড় চলে আসেন জনগণের কাতারে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কলামিস্ট আঃ গাফ্ফার চৌধুরী বলেন,১৯৫১-৫২ সালে আমি যখন ঢাকা কলেজের ইন্টরমেডিয়েটের ছাত্র তখন তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি তখন যুবক এবং ক্লাশে অর্থনীতির মতো দুরূহ বিষয় এমন অন্তরঙ্গভাবে পড়াতেন যে কেমন করে ঘন্টা কেটে যেতো তা আমরা ছাত্ররা অনেক সময় বুঝতেও পারতাম না ।” অত্যাচারী ও প্রজানীপিড়ক শাসকের নিকট থেকে জনগণের অধিকার আদায় করতে গিয়ে বহুবার তিনি করাবরণ করেছেন। সততাকে আকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন যোগাতে তার অবদান ছিল অনবদ্ধ। ১৯৩৭ সালে তার রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি; যদিও সক্রিয়ভাবে (চাকুরি ছেড়ে দিয়ে) রাজনীতিতে আসেন ১৯৫৪ সালে। তখন তিনি দেবিদ্বার আসন থেকে খান বাহাদুর কায়দে আযম মাওলানা মফিজ উদ্দিন আহমদকে পরাজিত করে প্রথম বারের মত এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে তিনি পুনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য পদ লাভ করেন। আশির দশকে তিনি একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তালিকাভূক্ত এবং নিবন্ধনকৃত একটি রাজনৈতিক দল। দলটির নির্বাচনী প্রতীক কুঁড়ের ঘর। অন্যদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ নামে) আরেকটি রাজনেতিক দল নিবন্ধন লাভ করেছে। দলটির মার্কা হচ্ছে গাভী। বর্তমানে বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবের রহমান গনি। অবিভক্ত ন্যাপের জন্ম হয় ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই। ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্ম প্রকাশ করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালে ৬ দফার মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্বস্বাশন দাবি করলেও ন্যাপ নেতৃবৃন্দ দাবি করেন ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলার স্বায়ত্বশাসনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহুত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশিষ্ট কলামিস্ট, লেখক ও গবেষক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন-(ন্যাপের ৫৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে) “১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের সাথে রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে আপোস প্রস্তাবে অসম্মত শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এলে বিমান বন্দর থেকে কাকরাইল পর্যন্ত জনতার সংবর্ধনা ও মিছিলে খোলা ট্রাকে জনতার অভিবাদনের জবাব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন বঙ্গব›ধুর পেছনে খোলা ট্রাকেই জনতার অভিবাদন গ্রহণরত এই নেতাকেও আমি দেবদারু বৃক্ষের মত শির উচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”

১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অভিভক্ত ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ২০১২ সালে ন্যাপের ৫৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেসব দল নেতৃত্ব দান করেছিল তাদের মধ্যে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) অন্যতম। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এ সরকারে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ স্থান পেলেও সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিতে অন্যান্য দলের নেতাদের স্থান দেয়া হয়। ৮ সেপ্টেম্বর গঠিত এ কমিটির আহবায়ক ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মাওলানা আঃ হামিদ খান ভাসানী, মনোরঞ্জন ধর ও কমরেড মনিসিং। তিনি বাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায়ের লক্ষে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেন। ৪ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করা হলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করে। ৫ ডিসেম্বর একই প্রস্তাব আনা হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২য় বার ভেটো দেয়। এসময় “তাস ” মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েট সরকার “পূর্ব বাংলার জনগণের আইন সঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানানো হয়। আমেরিকা যখন দেখল যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেছে তখন পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ৯ ডিসেম্বর নির্দেশ দেয়া হলে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর প্রবেশ করলে সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি অত্যাধুনিক নৌযান পাঠায়। এসংবাদ পেয়ে ৭ম নৌবহর পিছু হটে যায়।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদ জনগণের মধ্যে পৌছেঁ দেয়ার লক্ষে “নতুন বাংলা” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় মুজিবনগর থেকে পত্রিকাটি প্রকাশ পেত। ১৯ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের খবর ছাড়াও সরকারের পরামর্শদাতা কমিটির কার্যক্রমের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের আলাদা গেরিলা বাহিনী ছিল। ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেবিদ্বার উপজেলার নলআরায় (ফতেহাবাদ গ্রামে) এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের গ্রামে (এলাহাবাদ) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে চলে যেত। ন্যাপের গেরিলা বাহিনী পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের অনেকেই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বিশেষ করে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায় যুদ্ধে বেশ কয়েকজন নিহত হন। প্রতি বছর ১১ নভেম্বর বেতিয়ারা দিবস পালন করা হয়। বেতিয়ার যুদ্ধে শহীদ হন নিজাম উদ্দিন আজাদ, বশির মাস্টার, সিরাজ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। উল্লেখ্য, তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু দুই পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয় ছিল ন্যাপ পার্টি। ন্যাপ সম্পর্কে কতগুলো শাশ্বত উক্তি হচ্ছেঃ ন্যাপের মূলমন্ত্র-ধর্ম-কর্ম গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র, রাজনীতির ধারক ও বাহক হচ্ছে সংগঠন, সমাজতন্ত্র ছিল আছে, থাকবে। বাঙ্গালী তুমি ক্ষুদ্র নও, তুমি তুচ্ছ নয়। একবার জেগে উঠ,দেখবে তুমিও বিশ্ববিজয়ী হতে পারবে।

 

কিছুকাল আগে এনটিভির সাথে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন- রাজনীতি কোন ব্যবসা নয় , পেশাও নয়, রাজনীতি একটি ওয়াদা। এর মূল লক্ষ্য মানুষের সেবা করা। রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো স্বীয় দেশের প্রতি মমত্ববোধ, দেশের কল্যাণ এবং জনগণের সার্বিক কল্যাণে অবিরাম সংগ্রাম। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তাতে তিনি ‘ডাক’ গঠনে নেতৃত্ব দেন। এসময় তাকে করাবরণ করতে হয়। এছাড়া এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোন করতে গিয়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। তার স্ত্রী আমেনা আহমেদ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য ছিলেন । এই মহান নেতা সম্পর্কে তিনি জীবিত থাকাকালীন সময়ে বিশিষ্ট গবেষক কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছিলেন -নীতিহীন রাজনীতির এই দেশে তিনি নীতি ও চরিত্রের প্রতীক হয়ে আরও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকুন।

লেখক: প্রভাষক ও গবেষক।