স্মৃতির আয়নায় প্রাণের শহর কুমিল্লা


।। মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী ।।
ফেলে আসা সুখ দুঃখের বর্ণালী দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিপটে নড়াচড়া করা মানুষের চিরন্তন অভ্যাস। ৩০/৪০ বছর পর পেছনে তাকিয়ে অনেক কিছুই অস্পষ্ট মনে হয়। কুয়াশার শীতের সকালের মত কেমন ঝাপসা বোধ হয়, কি যেন একটা কথা মনে পড়েও পড়ে না। স্মৃতি নিয়ে মানুষ গ্রহণ বর্জনের এক ধরনের খেলায় মেতে থাকে, কিছু রেখে কিছু ফেলে। সেই থেকে যাওয়া স্মৃতিগুলোই অন্ধকার সমুদ্রে জেগে থাকা বাতিঘরের মতো পথ দেখায়।
১৯৭৬-১৯৭৯ এ সময়টায় আমি বজ্রপুর আনন্দময়ী কালিবাড়ি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ইংরেজি ‘এল’ টাইপের টিন শেডের স্কুল ঘর ছিল তখন। জোরে বৃষ্টি আসলে স্কুলের ভিতরে পানি ঢুকে যেতো। আনোয়ার স্যার, সহিদ স্যার, কামরুন্নেছা ম্যাডাম, একজন হিন্দু ম্যাডাম (নামটা মনে নেই) দের কথা মনে পড়ে। আমরা ৩ ভাই-বোন একই সময়ে এ স্কুলে পড়তাম। আমার সাথে অন্জু, দীপঙ্কর, দিপু, হারাধন, শিপ্রা, বিকাশ, আরো অনেকে পড়তো। স্কুলের পেছনে ছিল কালিবাড়ি পুকুর। অন্য পাশে কালি মন্দির। বর্ষার সময় পুকুরের পানি স্কুলঘর ছুঁই ছুঁই হয়ে যেত। বৃষ্টি আসলে টিনের ছিদ্র দিয়ে ক্লাসরুমে পানি পড়তো। স্কুলের গেইটে ছিল নারু দাদাদের মিষ্টি দেকান। সে দোকানের গজা এবং লবঙ্গ আমরা খুব মজা করে খেতাম। স্কুল শেষে সাতছড়া, বৌ ছি, ডাংগুলি, মার্বেল খেলতাম। আমাদের বাসার গলিতে আমার মার্বেল, সাতছড়া কিংবা ডাংগুলি খেলার সাথী ছিল বেলাল ও আনোয়ার। মাঝে মাঝে এ ছোট জায়গায় আমরা ফুটবলও খেলতাম। তাছাড়া সিগারেটের প্যাকেট জমিয়ে কি যেন একটা খেলাও আমরা খেলতাম। আমি ঘুড়ি উড়াতে পছন্দ করতাম, বেলালদের বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াতাম। ভাত দিয়ে সুতা মান্জা (ধাঁর) দিতাম।
একবারের কথা মনে পড়ে। আমরা তখন ক্লাসে করছি। হঠাৎ করে একটা গরু ক্লাসে ঢুকে একজনের খাতা মুখে নিয়ে খেতে শুরু করলো। ভয়ে সেদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল। গরু যে কাগজ খেতে পারে এ বিষয়টি ছোট বেলায় আমার মাথায় আটকে যায়। রোজার মাসে ‘সবুজ কুঁড়ি খেলাঘর আসর’ এর তত্ত্বাবধানে শৈলরাণী স্কুলে অতিরিক্ত ক্লাস, শরীরচর্চা, খেলাধুলা আয়োজিত হতো। মাসের শেষ দিকে পুরস্কার দেয়া হতো। আমি বরাবর ক্লাস পরীক্ষায় ভালো করতাম। এতে একটা পুরস্কার আমার ভাগ্যে জুটতো।
১৯৮০-৮৬ সাল ক্লাস ফাইভ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত আমি কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। কুমিল্লা জিলা স্কুলে আমি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতাম। বাসা থেকে বেরিয়ে রাজগঞ্জ বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে রাজবাড়ির সামনের রাস্তা ধরে উজির দিঘির পাড় হয়ে স্কুলে পৌঁছাতাম। রাজবাড়ির সামনের রাস্তায় এক দুধওয়ালাকে কলসের মধ্যে দুধ নিয়ে বসে থাকতে দেখতাম। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে ‘রূপকথা’ সিনেমা হল পড়তো। তখন সিনেমা হলে বেশ ভিড় হতো। মনে পড়ে আমরা দলবেঁধে রাজ্জাক-শাবানা ও মাস্টার শাকিল অভিনীত ‘ছুটির ঘন্টা’ ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। ছবির শেষ দৃশ্যে শিশু শিল্পীর স্কুলের বাথরুমে আটকে পড়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি আমাদের শিশু মনে খুবই আচঁড় কেটে যায়। ছবি শেষে অনেকেরই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।
বজ্রপুর ইউসুফ হাইস্কুলের খানিকটা আগে ‘গাজী লাইব্রেরি’- তে কুয়াশা, দস্যু বনহূর, মাসুদ রানা ইত্যাদি বইগুলো দুই টাকা ভাড়া দিয়ে পড়া যেত। আমি বই সংগ্রহ করতাম, অন্যদেরও ধার দিতাম। এ সময়টা খুব আনন্দে কেটেছে। গাজী লাইব্রেরির পেছনটায় ছিল কালিবাড়ি পুকুর। আমি লাইব্রেরির পেছন রুমটায় বসে বই পড়তাম। টলমলে পানি, মৃদুমন্দ বাতাস কি অপার আনন্দে সময় কাটিয়েছি।
ক্লাস ফাইভে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ফুটবল খেলার আগ্রহ বাড়তে থাকে। আমি জিলা স্কুলে পড়লেও ফুটবল খেলতাম ইউসুফ স্কুল মাঠে। পরে জিলা স্কুল মাঠে মুজিব ভাইয়ের কোচিং এ খেলেছি বেশ কিছুদিন। আমাদের সময় বজ্রপুরে ইউসুফ স্কুল মাঠে জমজমাট ফুটবল খেলা হতো। ফারুক ভাই, দিলীপ দা, নেপাল দা, শানু ভাই, বাদল দা, জিবু দা, আরো অনেকেই খেলতো। পরের দিকে তাপস দা, শংকর দা, মুকুট, আবুল, বাবু ভাই, আমি, উৎপল দা, সুভাস, কার্তিক, অন্জুসহ আরো অনেকেই খেলতাম। আমি ফুটবলে রাইট স্টপার ব্যাক হিসেবে খেলতাম। খেলার শেষে আমরা দারোগাবাড়ি পুকুর কিংবা নানুয়াদিঘীতে দল বেঁধে দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করতাম। এ সময়টায় আমরা খুব মজা করতাম। সাঁতার প্রতিযোগিতা করা, পুকুর পাড় থেকে লাফ দেয়া, ডুব দিয়ে লম্বা সময় পানির নীচে থাকা এগুলো নিয়ে মেতে থাকতাম। আমি দারোগাবাড়ি পুকুরে এপাড় থেকে ওপাড়ে পাড়ি দেয়ার সাহস করতাম কিন্তু নানুয়াদিঘি পাড়ি দেয়ার সাহস করতাম না। পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে চোখ লাল হয়ে যেতো, যার জন্য ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরতাম।
আমাদের পাড়ায় আমিন বেকারির পাউরুটি, বাটার বান খুবই মজাদার ছিল। বাসার গলির উল্টোপাশে ছিল জলিল ভাইয়ের খাবার হোটেল। সকাল ১১ টার সেখানে সিংগারা বানাতো। সিংগারার ভেতরে বাদাম থাকতো। এ সিংগারা আমার পছন্দের ছিল। আরেকটা প্রিয় খাবার ছিল মিষ্টি লুচি। গলির মুখে তাহের ভাই এর দোকান থেকে কত যে চকলেট খেয়েছি তার হিসাব নেই। আহা সেই মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো।
আমাদের ছোট বেলায় কুমিল্লা ছিল একটি ছিমছাম প্রাণবন্ত আন্তরিকতায় ভরপুর প্রাণের শহর। মোটামুটি শহরের অনেকেই একে অন্যকে চিনতো। হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে বা বড়জোর ক্রিং ক্রিং শব্দে রিকশায় চড়ে মানুষজন যাতায়াত করতো। মটর সাইকেল বা কার খুব বেশি ছিল না।
আজ এত বছর পরেও সেই আশির দশকের প্রিয় শহরটার কথা বার বার মনে পড়ে।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।