হৃদয়ে অমলিন

 

inside post

মানুষ মাত্রই মরনশীল। মৃত্যু অমোঘ জেনেও এ স্বল্প জীবনে কেউ কেউ মানবকল্যাণে এমন কিছু কীর্তি রেখে যান, যারা মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকেন। এমনি একজন প্রয়াত আব্দুল মতিন খসরু। আজ তাঁর ২য় মৃত্যু বার্ষিকী। উনার চলে যাওয়া স্বপ্নের মত। শত শত নেতা কর্মীকে অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে গত ১৪ এপ্রিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দের এদিনে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি ছিলেন এ জনপদের উন্নয়নের রূপকার এবং জনগণের আস্থার বাতিঘর।
এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ খিস্টাব্দে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মিরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা মো: আব্দুল মালেক তিনি সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতেন এবং মাতা জাহানারা বেগম পেশায় গৃহিনী । এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু জীবদ্দশায় এক ছেলে এবং এক মেয়ে রেখে গেছেন। ব্রাহ্মণপাড়া – বুড়িচং উপজেলার উন্নয়নের রূপকার, অকুতোভয় বীর , দূর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ, কালাকানুন নামক রাহুগ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করার মহানায়ক এবং বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু ১৯৭৮ সালে প্রথম কুমিল্লা জর্জকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হন এবং ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইন চর্চা শুরু করেন। সর্বশেষ ২০২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অবিভক্ত বুড়িচং থানা মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি তৃণমূল থেকে উঠে এসে জাতীয় রাজনীতির চূড়ায় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তর কুমিল্লা থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত একমাত্র সংসদ সদস্য ছিলেন। সে সময় বিএনপি সরকার গঠন করে এবং আওয়ামীলীগ বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সংসদে আব্দুল মতিন খসরু প্রতিটি অধিবেশনে গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজের মেধা , বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দেন ফলে নিজ দলে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৯৬ , ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে ব্রাহ্মণপাড়া – বুড়িচং উপজেলার রাস্তাঘাট , ব্রীজ কালভার্ট , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন , হাসপাতালসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয় । দূর্গত ও অবহেলিত কুমিল্লা – ৫ ( ব্লাহ্মণপাড়া – বুড়িচঃ ) কে তিনি মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং কিছু দিন পর পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তিনি দূর্নীতিমুক্ত থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও সুনামের সাথে তাঁর এ দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসের কুখ্যাত ব্যাক্তি খন্দকার মোসতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল । পরে ১৯৭৯ সালে এটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয় । ৯ জুলাই ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধনী আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন। যার অর্থ হলো ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে রেহাই দেয়া। দীর্ঘ ২১ বছরও এ কালাকানুনের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলেনি । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অনেকের কড়া রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে সপ্তম জাতীয় সংসদে এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু কালাকানুন ইনডেমনিটি আইন বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।এ প্রস্তাবের উপর তিনি জাতীয় সংসদে পরম আবেগ , তথ্যবহুল ও যুক্তি নির্ভর যে ভাষণ দেন তা সংসদীয় ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ২০১০ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক ৫ম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ক্ষেত্রেও এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর এ আইন বাতিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালতে ১৫ আসামির মৃত্যুদন্ড হয় পরে ৩ জনকে খালাস দেয়া হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে সরকার গঠন করলে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। তাঁর এ অবদান জাতি চিলদিন শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। এছাড়াও তিনি সরকারি লিগ্যাল এইড আইন – ২০০০ প্রণয়ন করেন। এ আইন একদিকে যেমন আইনজীবীদের সম্মান বৃদ্ধি করেছে অপর দিকে প্রান্তীক জনগোষ্ঠীর আইনী সহায়তা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এ আইন প্রণয়নের জন্য তিনি আইনজীবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনেও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এছাড়াও গ্রামীণ আদালত বিল , কাজীদের সনদ নিবন্ধন ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর চিন্তা ভাবনা ছিল বৈচিত্রময় এবং আধুনিক। গণমূখী এবঃ অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। বার কাউন্সিলের সদস্য থাকাকালে তিনি আইনজীবীদের কল্যাণে ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আইনমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ লিগ্যাল অ্যান্ড জুডিশিয়াল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট নামে দুইশ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।
তিনি নির্লোভ , নিরহংকার, সজ্জন , পরোপকারী , ধার্মিক , আলোকিত একজন সাদা মনের সত্যিকারের আদর্শিক নেতা ছিলেন। যিনি কিনা তার দলের নেতাকর্মীদেরকে কীভাবে মিষ্টি করে কথা বলতে হয় , কীভাবে ভদ্র আচরণ করা যায় , পিতা – মাতা ও শিক্ষকের সাথে কীভাবে নম্র ব্যবহার করতে হয় তা শিক্ষা দিতেন। নেশার কুফল , সুদ ও ঘুষকে তিনি নিরূৎসাহিত করতেন। আওয়ামীলীগের দু:সময়ে তিনি দলের নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা প্রদান করে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন । তিনি অখন্ড কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন আহ্বায়ক, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের আহ্বায়ক , বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক , আইন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ফোরাম সভাপতিমন্ডলির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
হে অবিসংবাদিত নেতা, আপনি বেঁচে থাকবেন এ জনপদের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে যুগ যুগান্তর।
তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তোমার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক-
মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন
সংগঠনিক সম্পাদক
শিদলাই ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ

আরো পড়ুন