৮৬ বছরের এক তরুণের গল্প!

মহিউদ্দিন মোল্লা।।

প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি তার নামেই পরিচিত। কুমিল্লার সব মতের মানুষের মুরব্বি। বয়স ৮৬ বছর। শরীরের কিছু বার্ধক্য এলেও মনে চির তরুণ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে এখনও নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার বসবাস নগরীর মুরাদপুর জানুমিয়া মসজিদের পাশে। জানু মিয়া (জানে আলম চৌধুরী) তার দাদা। তার বাবা সুলতান আহমেদ চৌধুরী। মা সায়কা চৌধুরী। তার বড় বাবা আরবের রহমান চৌধুরী। বড় বাবার বাবা খান বাহাদুর আশরাফ আলী চৌধুরী। আশরাফ আলী চৌধুরী মূলত তাদরে বাড়ি ও বাড়ির সামনের মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তবে জানু মিয়ার সময় তাদের পরিবারের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। জানু মিয়ার সাথে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাদের বাসায় আড্ডা দেন।
আমীর আলী চৌধুরী বলেন, ১৯৩৭সালের ১৫মার্চ তার মা মারা যান। তখন তিনি ক্লাস সেভেনে পড়েন। মায়ের মৃত্যু তাকে একা করে দেয়। ৪৩সালে বিশ^যুদ্ধের সময় তাদের বাড়িটি বৃটিশ প্রশাসন নিয়ে যায়। তিনি নানার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া চলে যান। সেখানে শৈশবের অনেক সময় কাটে। নানার পরিবারও জমিদার ছিলো। বাবার ২য় পরিবার মিলিয়ে তারা তিন ভাই এক বোন। ১৯৪৬সালে কুমিল্লায় ফিরে আসেন। কুমিল্লা রেল স্টেশনে নামার যে দৃশ্য দেখেছেন। সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। নেমে দেখেন স্টেশনে দুইটি মাত্র রিকশা। বাকী সব গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে বাসায় ফিরেন। পথে সব গরুর গাড়ি। কোন রিকশা নেই। পিচঢালা রাস্তা ছিলো না। কংক্রিটের রাস্তা। তাতে পানি ছিটানো হতো। কী সুন্দর খোলামেলা শহর। সেই নির্মল পরিবেশ এখনও খুঁজে বেড়ান।
আমীর আলী চৌধুরী বিয়ে করেন কুমিল্লার সুয়াগাজী চৌধুরী বাড়িতে। তার তিনজন ছেলে একজন মেয়ে। গত বছর স্ত্রী মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আবার একা হয়ে পড়েন। তার সময় কাটে সামাজিক কাজ ও বই পড়ে।
আমীর আলী চৌধুরী বলেন, কুমিল্লা ইউসুফ হাই স্কুল,ভিক্টোরিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। ৩০বছরের মতো সময় দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন। ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রথম সংগীতের ক্লাস চালু করেন। অবসর নিয়েছেন ২৮বছর। শিক্ষকতা জীবনে চেষ্টা করেছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে। অবসর সময়েও থেমে থাকেননি। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সামাজিক কাজে জড়িত থাকার চেষ্টা করছেন।
বাড়িতে গানের আসরের বিষয়ে তিনি বলেন, দাদা জানু মিয়া সৌখিন মানুষ ছিলেন। তার সাথে আমাদের বাড়িতে গানের আসরে আড্ডা দিতেন কবি নজরুল। এছাড়া শচীন দেব বর্মণ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু,কুলেন্দু দাস,সুরেন দাসসহ কুমিল্লার এমন কোন সংগীতজ্ঞ ছিলেন না যিনি আমাদের বাড়ির আসরে আসেননি। নজরুলের ব্যবহৃত একটি তবলা আমাদের বাসায় ছিলো। পরে ঢাকাস্থ নজরুল ইনস্টিটিউটের অনুরোধে তাদের দিয়ে দেই।
জীবনের আনন্দের স্মৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মুজমদার,আজিজুল হকসহ দেশের গুণীজনরা আমার ছাত্র। তাদের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। আরেক ছাত্র বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত এমপি তো বাসায় এসে পায়ে ধরে সালাম শুরু করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কুমিল্লা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন,তিনি কুমিল্লার নাগরিক সমাজের অন্যতম অভিভাবক। সামাজিক কর্মকা-ের মাধ্যমে সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের জন্য তার অসামান্য অবদান রয়েছে। তার কাজ দেখে নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে। আমরা তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন,কুমিল্লার সর্বস্তরের মানুষের মুরব্বি প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী। তিনি একজন আলোকিত মানুষ। অবসরে আসার পরও ঘরে বসে থাকেননি। নিজেকে সমাজের কাজে নিয়োজিত করেছেন। তার কাজ দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হচ্ছি। তার সান্নিধ্যে থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি শিখছি।