গ্রামের ঘরে ঘরে দুধের নহর!
মহিউদ্দিন মোল্লা,
কুমিল্লার লালমাই উপজেলা। উপজেলার ১০-১২টি গ্রামের ঘরে ঘরে দুধ উৎপাদন হচ্ছে। গরু পালন,দুধ বিক্রি ও শ্রমিকের কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন ছিলোনিয়া গ্রামসহ ও পাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। ছিলোনিয়া গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার দুধ উৎপাদন করেন। বর্তমানে ছিলোনিয়া দুধের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ছিলোনিয়া ছাড়াও পাশের গজারিয়া, হাফানিয়া, পদুয়া.মাতাইনকোট,দোসারি চৌ,জামমুড়া,শাসনমুড়া,আটিটি,বাটোরা গ্রামে সকাল- বিকাল দুধ সংগ্রহ ও বিক্রির উৎসব বসে। যেন গ্রামের ঘরে ঘরে দুধের নহর বইছে!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রাম জুড়ে গরুর হাম্মা হাম্বা ডাক। মাঠে চাষ করা হয়েছে উন্নতমানের সবুজ ঘাস। পুকুরে আনন্দে চরছে হাঁস। উঠানে দোল খাচ্ছে শিশুরা। পরিবারের লোকজন কাজে ব্যস্ত। কেউ গরুর ঘাস কাটছেন। কেউ গোবর পরিষ্কার করছেন। কেউবা দুধ সংগ্রহ করছেন। প্রতিদিন ছিলোনিয়া গ্রামে গড়ে ছয় হাজার লিটার দুধ পাওয়া যায়। সকাল ৭টা। গরু দুধ ধোয়ানো চলছে। হাতে তেল মেখে ওলান থেকে দুধ নেয়া হচ্ছে। চিরিৎ চিরিৎ শব্দে দুধ পড়ছে বালতিতে। সাদা দুধে ভর্তি হয়ে যায় বালতি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে দুধের মিষ্টি ঘ্রাণ। এদিকে সাড়ে ৮টায় ছিলোনিয়া গ্রামের আবদুল আজিজের খামারের সামনে ছোট খামারিরা তাদের গরুর দুধ এনে জড়ো করেন। ভোরের সোনালি আলো সাদা দুধে পড়ে চিক চিক করে। দুধ বিক্রির নগদ টাকা পেয়ে খুশিতে চক চক করে উঠে বিক্রেতার মুখ। অপরদিকে ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা,পিকআপ ভ্যান নিয়ে দুধ কিনতে হাজির হন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সেই দুধ চলে যাবে কুমিল্লা,লাকসাম,চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মিষ্টি দোকানে।
স্থানীয় সূত্র জানায়,ছিলোনিয়া গ্রামে এক যুগ আগে আবদুল আজিজ প্রথম বাণিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদন শুরু করেন। আজিজ সার-কীটনাশকের ব্যবসা করতেন। ২০০৩ সালের কথা। তার বড় মেয়ের জন্ম হয়। তার খাবারের জন্য বাড়িতে একটি গাভী পালন করতেন। ১৪হাজার টাকায় গাভীটি কিনেন। ছয় কেজি দুধ পেতেন। এক কেজি রেখে পাঁচ কেজি বিক্রি করতেন। এতে ভালো আয় হতো। পরে চিন্তা করলেন গাভী বাড়াবেন। একটা দুইটা করে গাভী বাড়ান। ২০০৬সালে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন। ২০১০ সালে ব্যাংক থেকে সহযোগিতা নিয়ে তিনি বড় ফার্ম গড়ে তোলেন। দুধের গাভী, মোটাতাজাকরণ করা গরু, বাছুরসহ তার বর্তমানে তিনশটি গরু আছে। তার পুঁজি রয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। বাড়িতে আড়াই কোটি টাকা দিয়ে করেছেন সুরম্য প্রাসাদ। কিনেছেন চার কোটি টাকার জমি। তিনি গরুর খাবারের জন্য কয়েক একর জমিতে ঘাস চাষ করেছেন। তার খামারে কাজ করছেন গ্রামের ১৮জন মানুষ। তার দেখাদেখি এই গ্রামে এখন শতাধিক গরুর খামার গড়ে উঠেছে। ছয়টি পয়েন্টে এসব খামারের দুধগুলো সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেগুলো বিভিন্ন বাজারে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের নিকট পাঠিয়ে দেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রতিকেজি দুধ ৫৫ টাকায় সংগ্রহ করে তা বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। আবদুল আজিজ অতিরিক্ত দুধ দিয়ে একটি মিষ্টি কারখানাও গড়ে তুলেছেন।
খুচরা বিক্রেতা আবদুল করিম বলেন, আমার ছয়টি গাভী আছে। ৩০লিটার দুধ আজিজ ভাইয়ের নিকট বিক্রি করি। এর আয় দিয়ে আমার পরিবার চলে। আজিজ ভাই চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন।
ছিলোনিয়া গ্রামের সর্দার হাবিব উল্লাহ বলেন, আমি নিজে খামারি। ৮টি গরু আছে। ৫টি দুধ দেয়। ৫০ কেজি দুধ পাই। এদিকে ছিলোনিয়া গ্রামের মানুষ ভোর থেকে গরু পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে গ্রামে নেই কোন হানাহানি।
পাইকারি ক্রেতা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাশিনগর এলাকার মীর হোসেন বলেন, প্রতিদিন সকালে ছিলোনিয়া গ্রামে আসি। ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা যোগে দুধ নিয়ে হাইওয়ের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বিক্রি করি।
আজিজ ডেইরি অ্যান্ড সুইটমিটের মালিক আবদুল আজিজ বলেন, লেগে থেকে পরিশ্রম করলে যে কারো খামার করে ভালো করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, সব ক্রেতা সব সময় দুধ নেন না। এতে দুধ জমা হয়ে যায়। কম দামে বিক্রিতে বাধ্য হন খামারিরা। একটি হিমাগার করা গেলে প্রয়োজনে দুধ সংরক্ষণ করা যাবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লার বুড়িচং,সদর দক্ষিণ ও লালমাইতে বেশি দুধ উৎপাদন হয়। লালমাইয়ের ছিলোনিয়া গ্রামে অনেকগুলো দুধের খামার রয়েছে। তাদের বিভিন্ন সময় আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। দিন দিন সেখানকার খামারিরা ভালো করছে। দুধ সংরক্ষণের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি সহসা একটি ভালো খবর পাবো।