নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন
।। রফিকুল ইসলাম সোহেল।।
কি দেখার কথা কি দেখছি,কি শোনার কথা কি শুনছি,কি ভাবার কথা কি ভাবছি, কি বলার কথা কি বলছি,৫৩ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি। হায়দার আলী সেই গানের লাইনগুলি মনে পড়ে গেল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর শেষ করতে যাচ্ছি,আমরা কি আজও স্বাধীন হতে পেরেছি। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে ২০২৪। একটি তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করবো আমরা আসলে কতটা স্বাধীন হতে পেরেছি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমানরা বেশি সেই এলাকা দুটি নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হলো। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হলো, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। এখন যেটি পাকিস্তান সেটির নাম পশ্চিম পাকিস্তান এবং এখন যেটি বাংলাদেশ তার নাম পূর্ব পাকিস্তান। মাঝখানে প্রায় তেরশ কিলোমিটার দূরত্ব। দুই প্রদেশের মানুষের মধ্যে ছিল বিশাল ব্যবধান- চেহারা, ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি সবই ছিল ভিন্ন। পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাব বজায় রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। শুধুমাত্র ধর্মীয় মিল ব্যাতিত অন্য কোনো মিল ছিল না। শুরু হয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা। এতোসব বৈপরীত্যের মধ্যে দুটি অংশকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে ধরনের মন-মানসিকতা উদারতা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা দরকার ছিল তা পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল না। তাছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ২৪ বছরের অর্থনৈতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। এসব পর্বতসম বৈষম্য বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে বিরাট প্রভাব রেখেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। যার মাধ্যমে স্বাধিকারের রাজনৈতিক গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, সফিক ও নাম না জানা আরো শহীদের রক্তের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলা ভাষা এবং এই ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে ধরা হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রীসভা ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ রুখে দাঁড়ায়। ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে সংবাদ পত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য জারি করা হয় ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেসন্স অর্ডিন্যান্স। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান যে কতটা অরক্ষিত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচ্য। এই আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকার সামরিক শাসন জারি করে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করা হয়। নানা টালবাহানা মধ্যে দিয়ে বাঙালি গণ রায়কে বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করছিল তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার। এর মধ্যে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে উদ্ধুদ্ধ করে প্রবলভাবে। এ ভাষণ বাঙালিকে উজ্জিবিত করে মুক্তি সংগ্রামের পথে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে রায়টি ঘোষণা করে সেটি স্বায়ত্তশাসন নয় পূর্ণ স্বাধীনতার। এই রায়কে দর-কষাকষি বা দল ভাঙাভাঙির মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না এটা টের পেয়ে পাকিস্তানি শাসকেরা সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যায় নামিয়ে দেয়। এই গণহত্যার প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। এই যুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ছিল না, এ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও। আমরা যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরিকল্পিত গণহত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধ। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হতে গড়ে তোলে মুক্তি বাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে পাক হানাদার বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এরপর ভারত ৪,১৫৬.৫৬ কিমি দীর্ঘ সীমানাকে সুরক্ষিত করতে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী আর আমাদের মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হতোদ্যম পাকবাহিনী যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যুদ্ধ বিরতির পরিবর্তে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী। এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনতার নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের যার নাম বাংলাদেশ। শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ৭১ দেশ স্বাধীন হলেও দেশের কাঠামোগত কোন পরিবর্তন হয়নি। পুরোনো আইন-কানুন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী ও আমলাতন্ত্র সবকিছুই আগের মতো রয়ে গেল। মানুষ আশা করেছিল পরিবর্তন কিন্তু সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশে যখনই যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তারা তাদের নিজেদের মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের কিংবা জনগণ গুণগতমানের পরিবর্তন নিয়ে মুখেমুখে কথা বললেও বাস্তবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুখে ধারণ করেছি কিন্তু অন্তরের ধারণ করতে পারেনি। আর তাই দুঃখজনক হলো সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীনতা নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল কিন্তু জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের কথা চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের কাঠামোকে ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনা তার পরিচালিত ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুম, খুন, আয়না ঘর, সন্ত্রাস, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণ, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, নির্বাচন বিহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশি প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্য দেশের স্বার্থ বিদেশিদের কাছে বিকিয়ে দেয়। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলী সেই সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের একটি ছায়া উপনিবেশে পরিণত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন চেষ্টা চলছিল। সেই সময় বাংলাদেশকে রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তর থেকে নেমে আসে কিছু ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তারা রাস্তায় নামলেও ধীরে ধীরে কোটা সংস্কারের নামে পুরো বাংলাদেশটা সংস্কারের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদের পতনের এক দফা আন্দোলনের ডাক দেয়। বিগত ১৫ বছরে বিরোধী দলগুলোর আহুত একের পর এক আন্দোলন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে যেভাবে দমন করেছে, ঠিক একই কায়দায় ছাত্রদের এই আন্দোলন দমনের কৌশল বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই ছাত্ররা ছিল দুর্দমনীয়, অদম্য। পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা বিগত ১৫ বছরের দমন পীড়নের মধ্যে ছিল তারাও যুক্ত হয় এই আন্দোলনের সাথে। এ আন্দোলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। শেখ হাসিনার আদেশকে অমান্য করে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ছাত্র-জনতা ও তার সৈনিকদের মনোভাব উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে রক্ষা করতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেন। ফলে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা ও সৈনিক মুক্তির আনন্দে সারা দেশের রাজপথে নেমে আসে। তারা মুহূর্তেই সারা দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের প্রতিটি আইকন ধ্বংস করে দেয়। ছাত্র-জনতা ফুল দিয়ে সেনা সদস্যদের অভিবাদন জানায়। ১৯৭১ স্বাধীন হয়েছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যে থেকে মুক্তির জন্য, স্বাধীন ভূখ-ের জন্য এবং সে স্বাধীন ভূখ-ে সবাই মিলেমিশে একসাথে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে করবো সেই লক্ষ্যে। কিন্তু বাস্তবে গত ৫৩ বছরে আমরা যা দেখলাম জনগণ আগের মতোই শাসকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা যে স্বপ্ন নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল এবং যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বসেছিল সেই স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। স্বপ্ন ছিল সমাজ বদলাবে, সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর হবে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। বরং বৈষম্য আরো বেড়েছে। শাসক শ্রেণির লুটেরা মনোভাবের কারণে অর্থনীতি বিকশিত হতে পারেনি। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মাটি ও সমুদ্রের নিচে যে সম্পদ আছে তাও নিরাপদে নেই। বিনিয়োগ সীমিত হওয়ার কারণে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি, বেকারত্ব ও হতাশা বেড়েছে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলাতে, মুক্তির অসমাপ্ত যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সমষ্টিগত মুক্তি অর্জন করতে ২০২৪ শের ৫ আগস্টের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনিবার্য। এই আন্দোলনে ত্যাগ-আত্মত্যাগে এবং মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে অকল্পনীয় ত্যাগের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। সেই অর্জনকে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে টেকসই মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজে লাগাতে পারলে সত্যিকার অর্থেই জনগণের মুক্তি মিলবে। ফিরে আসবে না ফ্যাসিস্ট শক্তি। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমার সোনার বাংলাদেশ। ৫৪ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে একজন নাগরিক হিসেবে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য।
লেখক: সাবেক ক্রিকেটার ও সংগঠক।