আমার কল্পনার হোটেল  — মোহাম্মদ শরীফ

অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আবিস্কার করলাম আমি একজন যথেষ্ট কল্পণা প্রবণ ও ক্ষেত্র বিশেষে অনুভূতিহীণ মানুষ! আমার সম্পর্কে আমার দর্শনে হয়তু অনেকে অবাক হতে পারেন। মজার বিষয় হলো, এই দু’টি গুণে মিলে এখনের আমি। কিছুটা ব্যাখ্যা করা যাক। ভাল খাবার আমার খুব প্রিয়। ইচ্ছে করে প্রতিদিন মুরগী পুড়া খাই। অথবা আমার তিন বেলার খাবার রুটিন হোক হাজী বিরিয়ানি  দিয়ে। বাঙালী মহাকবি চারবাক বলেছিলেন, ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং ক্রেতা ঘৃতং পিবেৎ’। অর্থাৎ যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো, ঋণ করে হলেও ঘি খাও। এই বিচারে আমি নিখাঁত বাঙালী। যেহেতু খাবারের প্রসঙ্গ এসেছে, রবীন্দ্রনাথের একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের লুচি খুব পছন্দের। আর ভারতে অহিংস আন্দোলনের নেতা মাহাত্মা গান্ধীর কালে  এই খাবারটি ছিল একেবারে বিষ। একবার মহাত্মা গান্ধীর পাশে বসে টকবগিয়ে লুচি খাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাত্মা স্বহ্য করতে না পেরে বলে উঠলেন, ‘কি খাচ্ছেন জানেন এগুলো? বিষ বিষ!’ রবীন্দ্রনাথ সহাস্যে রসিকতা করে বললেন, ‘বিষ বটে, তবে এর ক্রিয়া অনেক দুর্বল। অনেক দিন যাবৎ খাচ্ছি, কিছুই হচ্ছে না!’।
রবীন্দ্রনাথ নাকি বাড়ির রান্না ঘরে বসে নতুন রকমের রান্নার আবিষ্কারও করতেন। এছাড়া রাজা রামমোহন রায় নাকি একা একটি আস্ত পাঠা খেয়ে ফেলতে পারতেন। বাঙালির বিলাসী খাদ্য অভ্যাস চির কালের। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ গ্রন্থে বাঙালীর খাদ্যের কথাও বলেছেন। তখন বিলাসী আড্ডায় ঝলসানো মুরগী খাবারের কথা উল্লেখ্য করেছেন। এবার আমার কথায় আসি। একবার এক হোটেলে চাপ খেতে বসেছি। গরম গরম চাপ মুহূর্তেই সাবার করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পর হোটেল বেয়ারা এসে বললো, আজকে চাপ কেমন হলো ভাভ? আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আবিষ্কার করলাম, চাপ খেয়েছি ঠিক, তার স্বাদ কেমন লক্ষ্য করিনি। পরে জেনেছি  ঐদিন হোটেলের চাপ তেমন ভাল হয়নি! এই হলো আমার অনুভূতিহীনতা। আমার বন্ধুদের মধ্যে রয়েল (প্রান্ত ব্রহ্ম) কিছুটা এমন। তবে কামরুল তার একেবারে বিপরীত। খাবার মুখে দিয়েই বলতে পারে খাবারে কোন মসলার ঘাটতি অথবা অতিরিক্ত ব্যবহার ঘটেছে। তাই বন্ধুরা এক সাথে খাবার খেলে কামরুলের দিকে প্রথম তাকাই থাকি, তার সিদ্ধান্তে আমরা খাবারের ভাল মন্দ বিচার করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু করি। মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে খুব দ্বিধায় পড়ি। হয়তু রাত খুব গভীর হয়ে যায়। হঠাৎ করে ভুলে বসি আমি রাতে খাবার খেয়েছি কি না। তারপর চোখ বন্ধ করে কল্পণা করতে থাকি সন্ধ্যার পর আমি একে একে কি কি করেছি। এক সময় আবিস্কৃত হয় আমি খেয়েছি কি না। তারপর ভাবি, আমি কতটা অনুভূতিহীন। খাবার না খেলে তু এর উত্তর পেটের চাহিদার উপর বোঝা যায়! কিন্তু আমাকে খোঁজতে হয় স্মৃতির হাত ধরে। আমার অনুভূতিহীনতা যে কেবল খাবার কে ঘিরে; ওমন নয়। এটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই হয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায় কেউ আমাকে খুব আচ্ছা করে বকাজকা করছে, কিংবা রাগ দেখাচ্ছে। তারপরও দেখা গেল আমি নরমাল! যখন পাশের কোনো বন্ধু বলে দেয়, ‘তুকে যে কথা গুলো বলছে, আমার খুব রাগ চলে আসছে!’ তখন আমারও হঠাৎ মনে হয় আমারও তু রাগ হওয়ার উচিৎ ছিল! জানিনা, পাঠক আমার এই অনুভূতিহীনতা কে কোন প্রতিশব্দে বিচার করবেন। এবার আসি আমার স্বপ্নের হোটেল নিয়ে। আমি যে যথেষ্ট কল্পনা প্রবণ, এতে বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। ধরুণ, ভারত-বাংলাদেশ একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। টিভি তে খেলা দেখছি। প্রথম এক ওভার খেলা দেখার পর আমি আর দর্শক থাকি না। চোখ টিভিতে থাকলেও, মনে মনে ব্যাট হাতে নেমে পড়ি তামিম ইকবালের সাথে। কল্পনার ভারতে দেয়া ৩৫০ রানের টার্গেটে নেমে শুরুতেই যে হেনস্তাটা ভুবেনশ্বর কুমার ও জাসপ্রিট বুমরা আমার হাতে হন, তা কল্পনায়ও কল্পনার অতীত! ২০ ওভারে আমরা পৌছে যাই ২০০ রানের গোড়ায়। ৩৫ ওভারে পৌছতেই আমার ব্যক্তিগত ২০০ রানে কল্পনার সহজ জয় ছিনিয়ে আনি। এতো গেল ক্রিকেটের কথা। আবার যখন খবর দেখতে বসি, আমি হয়ে পড়ি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমার সাহসী উদ্যোগ বিশ্বনেতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সময়ে পিশাচ ইসরাইল কে আমার দেশে গোপনে তৈরী পারমানবিক বোমা মেরে আমি মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দেই। আমার হুংকারে বিশ্বনেতারা হয়ে পড়ে নিস্তেজ। যেহেতু আমি খাবার প্রিয়, কল্পনা টা খাবার নিয়ে খুব বেশী। বলা যায় প্রতিদিন তিন বেলা খাবার টেবিলে আমার কল্পনা গুলো নিয়মিত আওড়াই। আমি একদিন বিদেশ যাবো, আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সততার কারনে আমি অল্প দিনে ১ কোটি টাকা ইনকাম করবো। তবে সেটি আমার বন্ধু, আত্মীয় কাউকে বুঝতে দিবো না। আমাদের ঘরটি আগের মতোই থাকবে এর কৌশল হিসেবে। টাকা ইনকামের পর আমি দেশে চলে আসবো। কুমিল্লার শাসনগাছার আশে পাশে মোটামুটি বড় একটি হোটেল নিবো। শাসনগাছায় হোটেল নেওয়ার আমার অনেক গুলো কারন আছে। কারন এখানে নিম্ন আয়ের মানুষের পদ চারণা বেশী। বলে রাখি আমার হোটেলটি হবে নিম্ন আয়ের মানুষ ও শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে। কারন আমি দেখেছি মেসে শিক্ষার্থীরা ৩৫ টাকা মিল রেটে খাবার খেয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকে। আমি তাদের মোটামুটি ভাল খাবার খাওয়াবো। আমার খাবার আইটেমে হাফ মাছ, ভর্তা, শাক ও ডাল। তবে মাংস খাওয়াতে আমি কৃপণতা করবো না। আমি এই মোটামুটি আইটেম রাখার ৩টি কারন রয়েছে। প্রথমত, এই খাবার খাওয়াতে আমার ৪০ টাকা খরচ হলেও, আমি খাবার প্রতি বিল নিবো ২০ টাকা।
আর আমি যেহেতু দীর্ঘদিন এই সেবাটা চালিয়ে যাবো তাই একেবারে ফ্রি না করে এই ২০ টাকা বিল। আরেকটা কারন হলো, আমি একেবারে ফ্রি কাউকে খাওয়াবো না। এতে মানুষ অলস হয়ে পড়বে, এছাড়া আমার খাওয়ানো টা দেখা যাবে দান করার মতো; যা অনেক গ্রহীতাই লজ্জাবোধ করবেন। আমার এই হোটেল দীর্ঘদিন চলতে থাকবে। আমি যেহেতু মিডিয়া কর্মীদের সাথে চলেছি, তাই তারা আমার হোটেলের ব্যতিক্রমীত্ব সারা দেশে ছড়িয়ে দিবে। আমার পুঁজি যখন প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে আসবে, তখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আমার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ফান্ডে ৫০ লাখ টাকা দান করবে। তখন আবার আমার পুঁজি আগের অবস্থানে চলে আসবে।আমি এগিয়ে যাবো। হোটেলের সুস্বাদু খাবার আর জনপ্রিয়তার জন্য মানুষ অন্যান্য জেলা থেকে কুমিল্লায় আসবে আমার হোটেলে একবেলা খেতে। এভাবেই চলতে থাকবে আমার হোটেল।