শত বছর আগে কুমিল্লায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা,শাখা মুম্বাই-লন্ডনে
মহিউদ্দিন মোল্লা ।।
শত বছর আগে কুমিল্লায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এগুলোর শাখা ছিলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাসহ ভারতের মুম্বাই,দিল্লি,কলকাতা ও বৃটেনের লন্ডনে। ৩০এর দশক পর্যন্ত এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টির বেশি।
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, কুমিল্লার আগেও বাংলাদেশে ব্যাংক ছিলো। তবে সেগুলো ছিলো লোন বা ঋণ প্রদান অফিস নামে পরিচিত। স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা দিতো। বর্তমান আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয় কুমিল্লা থেকে। ১০৮ বছর আগে কুমিল্লায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। ১৯১৪ সালে দ্য কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের পূবালী ব্যাংকের কার্যালয়টি ছিলো সেই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। এটির শাখা ছিলো ঢাকা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভারতের কলকাতা, দিল্লি, লখনৌ, কানপুর, মুম্বাইসহ বিভিন্ন রাজ্যে ও বৃটেনের লন্ডনেও একটি শাখা ছিল।
ইতিহাসবিদ ও কুমিল্লার ইতিহাস নিয়ে লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থের সূত্রমতে, ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালে দ্য কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। ১৯৪০ সালে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ লাখ টাকা। ১৯২২ সালে দ্য কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড নামে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলার আইনসভার সদস্য ইন্দুভূষণ দত্ত। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় কুমিল্লায়। এর শাখা ছিলো সারা বাংলায়। কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুরে সোনালী ব্যাংকের বর্তমানে যে করপোরেট কার্যালয়, সেখানেই ছিল কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়।
নরেন্দ্র চন্দ্র দত্তের ছেলে বটকৃষ্ণ দত্ত ১৯৩২ সালে কুমিল্লায় নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক নামে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লার মহেশ প্রাঙ্গণের ছোট মোটর গ্যারেজ থেকে ব্যাংকটির জন্ম। ব্যাংকটির শাখা কুমিল্লার পাশাপাশি সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, ঢাকা এবং ভারতের কলকাতা, শিলচর, শিলং ও আসানসোলে ছিল। ১৯২৭ সালে কুমিল্লা কমার্শিয়াল ব্যাংক নামে আরও একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা খান বাহাদুর সিদ্দিকুর রহমান, আইনজীবী রায় বাহাদুর ভোদর দাশগুপ্ত, খান বাহাদুর আলী আহমেদ খান ও মুকুন্দ মাধব চৌধুরী। ১৯২৩ সালে বেঙ্গল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার অখিল দত্ত পাইওনিয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এখন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড যেখানে, সেখানেই ছিল পাইওনিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনের সার্বিক পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাঙালিদের আরও তিনটি ব্যাংকের সঙ্গে কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনকে নিয়ে ভারতে গঠিত হয় ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। কুমিল্লার ব্যাংকটির মূল প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার পরিচালক নিযুক্ত হন।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে,কমলাংক ব্যাংক, গান্ধেশ্বরী ব্যাংক, নিউ ওরিয়েন্ট ব্যাংক, রেডিয়েন্ট ব্যাংক, অ্যাসোসিয়েট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ভারতী সেন্ট্রাল ব্যাংক, পিপলস কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রভৃতি।
ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, ১৬৬০সালে বিখ্যাত বৃটিশ কর্মচারী ভ্যানড্যান ব্রুক একটি মানচিত্র তৈরি করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশে একটি নৌ- বন্দর ছিলো। যার নাম মারা বন্দর। এতে বুঝা যায় কুমিল্লা একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল। কুমিল্লাকে ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর বলা হয়। কারণ কুমিল্লায় শত বছর আগের অনেক গুলো ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। ট্যাংক(পুকুর-দিঘি) হারাতে বসেছে। এখনও টিকে আছে ধর্মসাগর,রানীর দিঘি,নানুয়ার দিঘি,উজির দিঘি ও আমীর দিঘি। তিনি বলেন, কুমিল্লার সঙ্গে সারা দেশের নৌপথ ও রেলপথকেন্দ্রিক যাতায়াতও বেশ সহজ ছিল। তখন ধান, পাট, লবণ ও কাপড়ের ব্যবসা ছিল বেশ চাঙা। তাই বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কুমিল্লায় অনেক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৭এর দেশ ভাগের পর ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ব্যাংক গুলো গুটিয়ে ফেলেন।