টাউন হলের বাতাসে গাঁজার গন্ধ
কয়েকবছর আগের ঘটনা। কুমিল্লা নগরীর প্রাণ টাউন হল প্রাঙ্গণ তখন উৎসবমুখর। একদিকে রবীন্দ্র-নজরুলগীতি, অন্যদিকে উচ্চাঙ্গসংগীত, কোথাও নাটক, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সভা আর মেলা; পুরো টাউনহল প্রাঙ্গণ জুড়েই ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের আবহ। কোথাও দর্শক-শ্রোতার কমতি ছিল না। যার যেটা ভালো লাগতো তা-ই উপভোগ করতেন। টাউন হল মাঠের পূর্ব ও পশ্চিম পাশ ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা। ক্বচিৎ দুই-একটা গাড়ি টাউনহলে প্রবেশ করতো, তা ছিল হাতেগোনা। বন্ধুরা শিশির ভেজা ঘাসে বসে গল্প করতো। পাঠাগারে পত্রিকা পাঠকের সংখ্যা ছিল নজরকাড়া। অনেকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন পাঠাগারে একটি সিট পাওয়ার আশায়।
গেলো কয়েকবছর কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে ভাটা পড়ে। মাঠের পূর্বপাশের সবুজ ঘাস ক্রমশ মলিন হয়। দোকানপাট বসতে থাকে। সবুজ ঘাস হয়ে যায় ধুলার মাঠ। কয়েক বছর আগেও শহীদ মিনারের কোণে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে কিছু লোক গাঁজা সেবন করতো। এখন সেই টাউনহলে বিকেল নামতেই প্রকাশ্যে গাঁজার আসর বসে। এমন মতামত এখানে আসা দর্শনার্থীদের। এনিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটি বেশ আলোচিতও হয়।
সংবাদে উল্লেখ করা হয়, দিনে শতাধিক যুবক প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন করে এই মাঠে। সন্ধ্যার পর পুরো টাউনহল প্রাঙ্গণে গাঁজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বন্ধুদের আনন্দ-উল্লাসের হর্ষধ্বনির বদলে ভেসে আসে একদল মাদকাসক্ত যুবকের বুনো উল্লাস। শুধু গাঁজা সেবন নয়, পুরো টাউনহল প্রাঙ্গণ জুড়েই অনিয়মের পসরা।
স্থানীয়রা জানান, গত ১০ বছর পূর্বে এখানে সামান্য কিছু দোকানপাট ছিল। বর্তমানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে এই মাঠে ৪০টির বেশি দোকান বসে। দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টাউনহলে বসা সকল দোকান মালিককে দিন হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এই টাকা আদায় করে টাউনহল কর্তৃপক্ষ।
দিনের বিভিন্ন সময়ে রেন্ট-এ কার, বাস, সিএনজি অটোরিকশার দখলে থাকে টাউন হল মাঠ। এসব গাড়ির কারণে টাউনহলে নিশ্বাস নিতে আসা পথচারীদের চলাচলে বিঘœ ঘটে। মাঝেমধ্যে টাউন হল মাঠের ভেতরেই যানজট লেগে যায়!
এদিকে টাউন হল মাঠের চতুর্দিকে প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করতে দেখা যায়। সাধারণ মানুষ টাউন হলে প্রবেশ করলে গাঁজা, সিগারেটের ধোঁয়া ও প্রস্রাবের গন্ধের মুখোমুখি হতে হয়। মাঠের চতুর্পাশে থাকা ড্রেনে প্রস্রাব করার কারণে তা সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
সূত্র জানায়, করোনার আগে পাঠাগারে বেশি পরিমাণ পত্রিকা রাখা হতো। এখন ওই পরিমাণ পত্রিকা রাখা হচ্ছে না। অনুকূল পরিবেশ না থাকায় ও পত্রিকার সংখ্যা কম হওয়ায় পাঠাগারমুখী পাঠকের সংখ্যা কমে গেছে।
কাজী আতিক নামে কুমিল্লার এক স্থায়ী বাসিন্দা জানান, কুমিল্লার মানুষের গর্বের জায়গা, প্রাণের স্পন্দন এই টাউন হল। আজ এই জায়গার এমন রুগ্ন দশা দেখে খারাপ লাগে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা) কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, টাউন হলের বর্তমান যে পরিবেশ, তা এককথায় শোভনীয় পর্যায়ে নেই। এখানে দোকানপাটসহ মানুষের চলাচল সীমিত করতে হবে। এতে ধূমপায়ীদের আনাগোনা কমবে। টাউনহল একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর যতটুকু শৃঙ্খলা থাকা দরকার তা নেই। দোকানপাট, গাড়ির গ্যারেজ ও অহেতুক আড্ডা কমতে টাউন হল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি প্রশাসনকে ভূমিকা রাখতে হবে। টাউনহল বাঁচাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের ভূমিকা থাকাও জরুরি।
টাউন হলের সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন জানান, টাউন হলকে কেন্দ্র করে যতগুলো অভিযোগ, তা শতভাগ সত্য। সন্ধ্যা হলে মাদকসেবীরা কুমিল্লা ক্লাব ঘেঁষা শহীদ মিনারের সামনে গাঁজা সেবন করে। গাঁজা ছাড়া তারা অন্য মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে বলেও আমার ধারণা। কেউ কেউ এখানে প্রস্রাব করে পরিবেশ নষ্ট করছে। এদের বেশির ভাগ শিক্ষিত যুবক। আমাদের মাঠকর্মীরা এদের কয়েকবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা কাটার দেখিয়ে ভীতি প্রদর্শন করে। আমি এটি নিয়ে আগেও কথা বলেছি। আগামী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটির মিটিংয়ে বিষয়টি আবারো উত্থাপন করবো।
দোকানপাট ও গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের টাউন হলের যে খরচ, তা হলের আয় দিয়ে পুরোপুরি মেটানো যায় না। তাই এখানে কিছু দোকানপাট বসার অনুমতি আমরা দিয়েছি। তবে প্রয়োজনে এগুলো তুলে নেওয়া হবে। এখানে কুমিল্লা ক্লাব আছে। তাই কিছু প্রাইভেটকার চলাচল করে। সে সুযোগে অন্য গাড়িও ঢুকে যায়। আমরা ওইসব গাড়ি প্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আমরা জানি,১৮৮৫ সালের ৬ মে ৩ একর ৪৩ শতক জায়গা নিয়ে কুমিল্লা টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। টাউন হলের প্রতিষ্ঠাতা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর। এটি কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। টাউন হলের বর্তমান পরিবেশ শোভনীয় পর্যায়ে নেই। দোকানপাট, গাড়ির গ্যারেজ ও অহেতুক আড্ডা কমতে টাউন হল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি প্রশাসনকে ভূমিকা রাখতে হবে।