আপসহীন রাজনীতিবিদ হাবিব উল্যা চৌধুরী

 

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।

ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম। কুমিল্লায় বাম ঘরনার রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করেছি ১৯৬৯ সাল থেকে। আমি তখন ইউসুফ বহুমুখী কারিগরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। হাবিব উল্যা চৌধুরীর সাথে তখনই পরিচয়। তিনি ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যয়নকালে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩খ্রি. পর্যন্ত তিনি দুবার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। প্রথমবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম। পরেরবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ব্যক্তিক দিক থেকে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সেক্টর কুমিল্লা অঞ্চলের মুজিব বাহিনী কমান্ডার ও যুদ্ধাপরাধী মামলার প্রধান প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান। মফিজুর রহমান বাবলুও পরবর্তী সময়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে হাবিব উল্যা চৌধুরী অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ থেকে চাঁদপুর মহকুমার রিলিফ কমিটির সভাপতি ছিলেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠিত হলে তিনি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কর্মীদের সাথে তিনি খুব সহজে মিশে যেতে পারতেন। কর্মীরাও তাঁকে আপন মনে করতো।

দুই.
হাবিব উল্যা চৌধুরী ১৯৪০ সালের ১৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আগেই বলেছি, হাবিব উল্যা চৌধুরীর সাথে আমার ছাত্রীজীবনে পরিচয় ঘটে, তবে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ১৯৮০ সালে বিনয় সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠার পর। এ সংগঠনের সভাপতি (১৯১৩-১৯১৫) ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর মজুমদার। তাঁর সাথে হাবিব উল্যা চৌধুরীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। হুমায়ূন কবীর মজুমদারের মৃত্যুর পর একদিন হাবিব উল্যা চৌধুরী বলেছিলেন, “আরে মিঞা শোন- মরতে তো একদিন হইবই। দুইডা হেছা কথা কইয়া মইরা যাওয়ন ভালা। এখন ভালা মাইনষের কথা হননের লোক নাই- একথা বলবো না তবে সংখ্যায় খুবই কম। হুমায়ূন মজুমদার মইরা গেছে, ভালাই হইছে। সৎসাহসের সাথে দুইডা হেছা কথা মানে সত্য কথা বলে যেতে পারছে। আজকের সমাজে হুমায়ূনদের মূল্যায়ন কোথায়? সে সত্যকে সত্য বলেছে মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছে। যা বলেছে মাথা উঁচা কইরা কইছে। ‘হ্যাডম’ আছে বইলাই কইতে পারছে।”
ওহে মনে পড়েছে, বিনয় সাহিত্য সংসদ আয়োজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর মজুমদার ও জেএসডি নেতা একেএম হুমায়ূন কবীরের লোকসভায় আপসহীন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে এভাবেই কথা বলেছিলেন। এটি ২০১৫ সালের ১২ আগস্টের কথা। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিনয় সাহিত্য সংসদের তৎকালীন উপদেষ্টা বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি হাবিব উল্যা চৌধুরীর স্নেহধন্যদের অন্যতম।

হাবিব উল্যা চৌধুরী ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কারণে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের কোনো একসময় তাঁর বাসায় গিয়ে হুমায়ূন কবীর মজুমদার স্মারকগ্রন্থে লেখা দেয়ার অনুরোধ করি। তিনি প্রথমেই বলেন, ‘কী হবে লিখে? কেউ পড়বে না।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যখন বলছো শরীরটা আরেকটু সুস্থ হয়ে নিক, লিখা দেব। এরপর আরও ২-৩ বার তাগিদ দিয়েছি। শেষ তাগিদ দেয়ার আগে শেষনিঃশ^াস ত্যাগ করলেন। ২০১৯ সালের ৩ জুলাই বুধবার তিনি অচিনপুরে পাড়ি দেন। আমার সম্পাদনায় বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর মজুমদারের স্মারকগ্রন্থ ‘চিরভাস্বর হে অগ্রপথিক’ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ২০২১ সালে।

তিন.
মনে আছে, ২০১৪ সালে বিনয় সাহিত্য সংসদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদার, ভাষাসংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর লায়লা নূরকে ‘বিনয় সম্মাননা পদক-২০১৪’ প্রদান করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী সংবর্ধিত অতিথি ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদারের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের উপর আলোচনা করেন। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের তৎকালীন কলেজ পরিদর্শক ড. মোঃ নিজামুল করিম আলোচনা করেন ভাষাসংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর লায়লা নূরের জীবনাদর্শ ঘিরে। কী প্রাণবন্ত ও গঠনমূলক আলোচনা। ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদারের উপর আলোচনা করতে গিয়ে এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী রীতিমত কেঁদে ফেলেন। আমি সেদিন আবিষ্কার করলাম তিনি কাঁদতে পারেন। যে কান্নায় কোনো ভনিতা নেই। আন্তরিক সে কান্নার প্রতিটি পরতে পরতে ছিল দরদী মনের ছাপ। ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদারের সাথে ছিল তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। আলী তাহের মজুমদারকে তাঁর বাসায় দীর্ঘদিন থাকতেও দেখেছি। বিনয় সাহিত্য সংসদের সেদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর মজুমদার। প্রধান অতিথি ছিলেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরীর সেদিনের বক্তব্য যদি রেকর্ড করা যেতো তাহলে আজকে বিশ্লেষণ করা যেতো তিনি কী মূল্যবান কথাই-না সেদিন বলেছিলেন। একটি কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র ও সরকার- এ দুটির সঠিক সংজ্ঞা আমরা অনেকেই জানিনা। জানিনা বলেই সরকারের সমালোচনা করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। ঠিক তেমনিভাবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক বা দ্বান্দ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অশুভ পায়তারা করা হয়।

আমরা জানি, কবি নজরুল ইসলাম অনেক আগেই ‘ডেমোক্রেটিভ সোশালিজম’ বা গণতান্ত্রিক সমাজবাদ এর কথাা বলেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সমান্তরালভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চার মূলনীতির আলোকে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন সেখানেও তো গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। পরের দুটি স্তম্ভ ছিল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অনাকাক্সিক্ষত প্রবেশ মূল জাতীয়তাবাদকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরবর্তী সময়ে আবারো চাঙ্গা হয়ে ওঠলেও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আঁচড় কাটেনি।

চার.
এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী কর্ণেল তাহেরের অনুরাগী ছিলেন। তিনি কর্ণেল সংসদ, কুমিল্লা জেলা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। একাত্তুরের ঘাতক দালাল কমিটি কুমিল্লা শাখারও আহ্বায়ক ছিলেন। রাজনীতিতে পোড় খাওয়া, নির্লোভ ও আত্মপ্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরী নিজে কম খেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর মাঝে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। নির্লোভ ছিলেন বলেই একবার এমপি ও একবার মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েও সুযোগ গ্রহণ করেননি। বই ও ফুল ভালোবাসতেন। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দুলর্ভ বই সংগ্রহ করতেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৃত গ্রন্থসমূহ মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। বক্তৃতা দেয়ার চেয়ে বক্তৃতা শুনতে পছন্দ করতেন বেশি। ঢালাওভাবে সবার বক্তৃতা শুনতেন না। তাঁর আদর্শের বা চিন্তা-চেতনার বাইরে কেউ বক্তৃতা দিলে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেও বিচারমূলক সমালোচনা করতেন না। সংক্ষেপে বলতেন, ‘ও জানেনা তা-ই বলেছে।’ আশির দশকের পর তিনি নেতৃত্বের জায়গা থেকে সরে এসে সংসারী হতে চেয়েছেন। সংগঠন বা সংগঠনের পক্ষে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। প্রায়শ বলতেন, “যা কিছু করবে সৎসাহস নিয়ে করবে। ‘হ্যাডম’ না থাকলে কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে না।”

১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর সাপ্তাহিক অভিবাদন-এ প্রকাশিত হয় আমার লেখা ‘জাসদ যুক্ত হচ্ছে : রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কী’ শীর্ষক নিবন্ধ। লেখাটি পড়ে হাবিব উল্যা চৌধুরী তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। বলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে সাবধানে কলম চালাবে। সময় তোমাকে সমর্থন করতে না-ও পারে’।

এরপর ২০১৫ সালের অমর একুশের বইমেলা উপলক্ষে যখন আমার বই ‘রাজনীতির সদর-অন্দর’ প্রকাশিত হয় তখন একদিন ডেকে বলেন, ‘তোমার সৎসাহসের প্রশংসা করছি। যদিও আমি অনেকটা কাঠখোট্টা ধরনের; সহসা কারো প্রশংসা করতে পারি না।

গ্রন্থটির ফ্ল্যাপে লিখা ছিল- মোতাহার হোসেন মাহবুব পর্যবেক্ষণ করেন স্থানীয় রাজনীতি-সংস্কৃতির নানা অচলায়তন ও সংকট; পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবহস্থার সর্বগ্রাসী রূপ। কিন্তু এসব ছাপিয়ে তাঁর রচনায় ফুটে ওঠে সেই রাজনীতির আদর্শিক দিক। জনমুখী ধারার ক্ষীণ রেখা। নিবন্ধধর্মী এ সংকলন-গ্রন্থ একদিকে স্থানীয় রাজনীতির আলেখ্য, অন্যদিকে আদর্শবাদী রাজনীতিকদের কর্মদর্শন মূল্যায়নের বিনীত প্রয়াস।

হাবিব উল্যা চৌধুরী বলেন, ‘তোমার এ বইটি পড়ে আমি যে কথা বলতে চেয়েছি, তা এ বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে। এ যেনো আমার অন্তরের কথা।’ সেই বোদ্ধাপাঠক শ্রদ্ধাভাজন হাবিব ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন -এ দুঃখবোধ সামাল দিই কীভাবে?

বলা প্রয়োজন, এ গ্রন্থের ফ্ল্যাপের লিখাটি লিখেছেন সে-সময়কার মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের গবেষণা কর্মকর্তা মামুন সিদ্দিকী। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা।

২০০৫ সালের ৯ জুন বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনের অনুষ্ঠিত হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম স্মরণসভা’। এ স্মরণসভাকে কেন্দ্র করে দৈনিক শিরোনাম-এ আমার লেখা ‘মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম স্মরণ সভার প্লাটফার্ম: কুমিল্লা টাউন হলে বসেছিল সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলা’ শীর্ষক নিবন্ধ। এটিও মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন এডভোকেট মবিব উল্যা চৌধুরী। তিনি আমাকে ডেকে বলেন, ‘মমতাজ আমার স্ত্রী ছিল, তার সম্পর্কে আমার চেয়েও তুমি বেশি জানো দেখছি’। হাবিব ভাইয়ের এ উক্তিতে আমি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। পরমুহূর্তে বলি, হাবিব ভাই নিবন্ধে যা লিখেছি তা আমার কথা নয়। স্মরণসভায় বক্তারা যা বলেছেন তা-ই উল্লেখ করেছি। তিনি হেসে বলেন, ‘কে কি বলেছে তা আমি শুনেছি। তুমি যা সংযোজন করেছো তা পড়ে অভিভূত হয়েছি। তোমাকে ধন্যবাদ।’ এডভোকেট হাবিব উল্যা চৌধুরীর সেদিনের অভিমত লেখালেখির ক্ষেত্রে দ্বিগুণ উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে উৎসাহ দেয়ার সেই মানুষগুলো ক্রমে অচিনপুরে পাড়ি দিচ্ছেন। হাবিব উল্যা চৌধুরী অশুভ পায়তারাকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন। সারাজীবন একই নীতিতে চলার চেষ্টা করেছেন। সৎপথে থেকে সীমিত আয়ে সংসার চালিয়েছেন। লোভ-লালসা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। সঙ্গত কারণে তিনি আমার নমস্য; পরম শ্রদ্ধাভাজন। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও গবেষক।