কিভাবে থামবে কিশোর অপরাধ

 

inside post

মহসীন কবির।।
কুমিল্লায় গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান হয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গ্যাং কালচার গড়ে তুলেছে কিছু কিশোর। এসব গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয়া গ্রুপগুলোর নামও অদ্ভূত। ঈগল, রয়েল বেঙ্গল, সিজলিং, জে অ্যান্ড জে, বিগ ব্রাদার, টুইস্ট, সেভেন স্টার, ব্ল্যাক স্টার ও ডিস্কো বয়েজসহ অর্ধশতাধিক গ্রুপে রয়েছে সদস্য সহস্রাধিক। নগরীর চর্থা,নগর উদ্যান, ফৌজদারি মোড়, মোগলটুলি,তালপকুর পাড়, ঠাকুরপাড়া, ধর্মপুর,শাসনগাছা, নোয়াপাড়া ও বাখরাবাদসহ অলিগলিতেই এদের দেখা মিলে। মূলত সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাই, মারামারি, মাদক সেবন ও স্কুল- কলেজের ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করাই এদের মূল কাজ। তাছাড়াও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের হাতে অপর বন্ধুর প্রাণ গেছে। গত দু’বছরে এ সংক্রান্ত ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৮ কিশোর-তরুণ। গত ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর সার্কিট হাউজের সামনে বিবাদে জড়ায় বিবদমান দু’পক্ষ। এসব কিশোর কাদের খপ্পরে পড়ে নিজেদের বিপথগামী করছে, তা খতিয়ে দেখে এখনই লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন কুমিল্লার শিক্ষাবিদরা।

সন্তানদের খোঁজ রাখতে হবে অভিভাবকদের
প্রফেসর ড. মো. আবু জাফর খান
অধ্যক্ষ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।
বর্তমানে নানাভাবে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব বিস্তার করছে কিশোর গ্যাং। কারণ এতে সম্পৃক্ত হয়ে অনেকেই নানা অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। দেখা
যায় একটা কিশোরের ৩০-৩৫ জন বন্ধু থাকে। কোনো জায়গায় ঝামেলায় জড়ালে তার এক হুইসেলেই এসব বন্ধু ছুটে এসে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, চুরি ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মেই তাদের সম্পৃক্ততা
থাকে। এতে করে নিজেরাও বিপথগামী হয় এবং পরিবারকেও উদ্বিগ্নতার ফেলে। তাই সন্তানরা কোথায় যায়, কার সাথে মিশে সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে অভিভাবকদের। কারণ কিশোর ছেলেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকে
একটি নির্দিষ্ট সময়ে। এই সময়ে অন্যায়ে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

চারিত্রিক ও মানবিক দিকগুলোর উন্নতিতে পদক্ষেপ নিতে হবে
ডা. মোহাম্মদ ইজাজুল হক
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।
কুমিল্লায় সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকা- নিয়ে সবাই আতঙ্কিত। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় বাবা-মাকে আরও সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের চারিত্রিক দিকগুলোর আরও উন্নতি করার পদক্ষেপ নেয়া
জরুরি। তাছাড়াও মানবিক কর্মকাণ্ডেও তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। অন্যথায় কিশোর অপরাধের মাত্রা আরও বাড়বে।

ধর্মীয় ও নৈতিক বোধ জাগ্রত করতে হবে
মো. শরিফুল ইসলাম
অধ্যক্ষ, ভাষা সৈনিক অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাং কালচারের কারণে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কায় পড়েছেন অভিভাবকরা। মূলত কাউন্সিলিংয়ের অভাবে টিনএজরা সঠিক পথ বেছে নিতে পারে না। অনেক সময় দূরত্বের কারণে বাবা-মায়ের সাথেও তাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে না। তাই অসৎ বন্ধুদের সাথে মিশে অন্যায়ের পথে ধাবিত হয়। অথচ পরিবার থেকেই ভালো-মন্দেও ধারণা দেয়া জরুরি। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বও কম নয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগ্রত করতে পারলে কিশোরদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে
আনিসুর রহমান আকন্দ
সভাপতি, কুমিল্লা কৃষি ও কারিগরি কলেজ।
শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে কিশোর অপরাধ দমন করা জরুরি। অনেক সময় না বুঝে ভুল বন্ধু নির্বাচন করে সন্তানরা। অসৎ সঙ্গের কারণে নিজেরাও অন্যায় পথে পরিচালিত হয়। তাই তাদেরকে এ পথ থেকে ফেরাতে ইতিবাচক
পদক্ষেপ নিতে হবে। বুঝাতে হবে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো। এক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার।

তরুণদের আস্তাহীনতা দূর করতে হবে
নার্গিস আক্তার
অধ্যক্ষ, কুমিল্লা কালেক্টর স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
আস্তাহীনতা থেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে কিশোর-তরুণরা। তাই তারা সঙ্গ খোঁজে। এক সময় সেই সঙ্গের মাধ্যমেই নিজের অজান্তে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। যা থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এ সময় মাদক, চুরি , ছিনতাই ও ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে তাদের নাম উঠে আসে। তাছাড়াও স্মার্ট ফোনের নেতিবাচক ব্যবহারেও অনেকে অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে তরুণদের বাঁচাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়া, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। স্মার্ট মোবাইল ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিষয়টিও নজরদারিতে রাখতে হবে।

ভয়ংকর ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে
মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর মাসউদ
অধ্যক্ষ, কুমিল্লা কমার্স কলেজ।
দিন দিন ভয়ংকর ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে ’কিশোর গ্যাং’ নামক সামাজিক ব্যাধিটি । তাদের সংঘবদ্ধ অপরাধ হচ্ছে হত্যা, রাহাজানি, চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা,ইভটিজিং, জমি দখল ও চাঁদাবাজি। গ্যাংস্টার, ঈগল, হাঙর, গাংচিল, কান কাটা মজিদ, ডেঙা মজিদ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন্ নামে তারা সক্রিয়। মূলত, তাদের কোনো দল
নেই। যখন যে ক্ষমতায় তখন তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে তারা। দুই একটি ঘটনায় প্রশাসন সজাগ হলেও পরবর্তী ঘটনা সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত আবার ঝিমিয়ে পড়ে। এক সময় এলাকার মুরুব্বিরা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কোনো ধরনের বেহায়াপনা ও উশৃঙ্খলতার সুযোগ দিতেন না। কিন্তু এখন সমাজের দায়িত্বটা স্থানীয়
রাজনীতিবিদদের হাতে, যাদের অনেকেই উল্লেখিত গ্যাংদের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয় দেন।

পাঠচক্রে কিশোর অপরাধ বিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
মহিউদ্দিন লিটন
অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডয়িাল কলেজ।
সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিতে যাওয়া কিশোর অপরাধ কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ দরকার। এ ব্যাপারে স্কুল-কলেজে কাউন্সিলিং কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। পাঠচক্রে কিশোর অপরাধ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা করা এখন সময়ের দাবি। বিনোদন পার্ক, বিপণিবিতান ও রাস্তায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি,
মাদকসেবন এবং ইভটিজিং থেকে শুরু করে নানা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে তারা। এতে সাধারণ মানুষের চলাফেরায়ও ঝুঁকি বাড়ছে।

শিক্ষক-অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি
মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ
প্রধান শিক্ষক, কুমিল্লা জিলা স্কুল।
কিশোর গ্যাং কালচার থেকে সন্তানদের রক্ষায় অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতনতা জরুরি। পরিবারে যেমন বাবা-মা, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সন্তানদের মূল অভিভাবক শিক্ষকরা। তাই কোনো পথভ্রষ্ট হয়ে যায় কী না,সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে শিক্ষকদের। এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ হলে তার তালিকা করতে হবে। নগরীতে কিশোর গ্যাং কোথায় কোথায় অবস্থান নেয়, সে বিষয়ে খোঁজ রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে পুলিশকে। এভাবে ধীরে ধীরে কিশোর অপরাধ কমতে পারে।

আরো পড়ুন