বাপ্পী দাস হত্যাকাণ্ডে মামলা কি আর হবে না?
।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী।।
ঘটনা ২৩ দিন আগের। ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিনের। যা এখনও খুব একটা আলোচনায় আসে নি।
সিটি উপনির্বাচনের দিন গণমাধ্যমে অগ্রাধিকার ছিল ভোটের খবর। সহিংসতার ঘটনাও ছিল। দিন শেষে প্রধান হয়ে ওঠে পাশ-ফেলের খবর। অন্য খবর তখন পেছনে চাপা পড়ে।
তেমনই একটি ঘটনা পথচারী বাপ্পী দাস গুলিতে আহত হওয়া। নির্বাচনের দিন গুলি- জখম-সংঘর্ষের এমন আরও ঘটনা ছিল। কিছু প্রকাশ পেয়েছে, কিছু পায় নি- গুরুত্ব হারিয়েছে ।
এ ঘটনায় আহত বাপ্পী চন্দ্র দাস(২৬) চিকিৎসা নিয়েছেন শুরুতে কুমিল্লায়, এরপরই ঢাকা মেডিক্যালে। ১১ দিন পর ২০ মার্চ বিকালে তার মৃত্যু হয়। অনেকটা সবার অলক্ষ্যে।
কুমিল্লার একটি পত্রিকা ২২ মার্চ গুরুত্ব দিয়ে খবরটি প্রকাশ করে। এতে কিছুটা জানাজানি হয়। পরে পুরনো হয়ে যাওয়ায় জাতীয় গণমাধ্যমে ফলাও হয় নি খবরটি। এরপরও আস্তে ধীরে দু’ এক পত্রিকায় ছাপা হয়।
শুরু থেকেই চাপা পড়ে যায় খবরটি । কারণ হত্যা না মৃত্যু এ নিয়ে আছে ধুম্রজাল। ধোঁয়াশা থাকায় নিরবতা ভর করে গরিব এ মৃত্যুর ওপর। ধোঁয়াশা মানে নগরবাসীর চেপে থাকা ভয়। তারা জানে তবে নিজ মুখে উচ্চারণ করে না। বললেও ফিসফিস করে একান্তে পাশের বিশ্বস্তজনের কাছে শেয়ার করে, এতটুকুই।
তাই এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ওপর ‘বাদ দেন’ বদতাছির ভর করেছে। সর্বশেষ আশ্রয় গণমাধ্যম দায়িত্ব নিয়ে ঘটনা জানিয়েছে যতটুকু পেরেছে । কারণ বাকিরা নিরব। এটাকে এখন পর্যন্ত একটি নিরবতা ভর করা মৃত্যু বলা চলে।
১৩ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ চর্থা লুৎফুন্নেছা গার্লস স্কুল ভোট কেন্দ্রের সামনের ঘটনা। ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজিউর রহমানের গণমাধ্যমে ভাষ্য , ওই কেন্দ্রের সামনের গোলাগুলির ঘটনায় সময় তার পেটে গুলি লাগে বলে তিনি শুনেছেন । গণমাধ্যম ও স্থানীয়দের ভাষ্য, ঘটনায় আরও একজন কাঠমিস্ত্রির হাতেও গুলি লাগে।
নিহতের মা মিতন চন্দ্র দাসের দাবি তার ছেলে বাড়ি ফিরছিল। গোলাগুলির সময় গুলিবিদ্ধ হয়। সে রাজনীতি করে না। একটি ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠানের টেকনিশিয়ান- লাইনম্যান । ৮ মাস আগে বিয়ে করেছে।
তবে স্থানীয়দের ভাষ্য ভিন্ন, তাদের অভিযোগের আঙ্গুল ওই ওয়ার্ডেরই এক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার দিকে। তাঁর শর্টগানের গুলি ছুটে গিয়ে পেটে লাগে। ওই নেতার নামে অস্ত্রটির ব্যক্তিগত লাইসেন্স থাকার দাবি রয়েছে। আবার কেউ বলছে সংঘর্ষের ঘটনা চলাকালে ওই নেতার গাড়ির চালকের কাছে থাকা ওই অস্ত্রের গুলি ছুটে গিয়ে লেগে যায়। অন্যরা বলছে, বিজয়োল্লাসের ছোড়া গুলি গিয়ে লাগে। অবশ্য এসবই পুলিশি তদন্তের বিষয়।
প্রশ্ন উঠেছে এখনও মামলা হলো না কেন, অপমৃত্যু বা খুন কোনটিই না। গণমাধ্যমে পুলিশের ভাষ্য, তাঁরা ঘটনা জানে। এখনও পরিবার মামলা করেনি। মৃত্যুর ঘটনার পরও অভিযোগ লাগবে, পরিবারের। মামলা রুজুর ব্যবস্থাও নেয় নি পুলিশ। নির্বাচনের দিনের ওই সংঘর্ষ -গোলাগুলির ঘটনায়ও কোন মামলা হলো না কেন। অনেকগুলো কেন। এতোসব প্রশ্নের উত্তরও পুলিশের কাছেই।
মরে যাওয়া পক্ষ গরিব মানুষ। তাদের যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। তবে পুলিশ নীরব কেন। এখন শোনা যাচ্ছে উল্টো আতংকে দিন কাটছে নিহতের পরিবারের। মামলা, বিচার চাওয়াতো দূরের কথা। তাহলে কি নিরাপত্তার অভাবে মামলা করে নি পরিবার। অভিযোগ ছাড়া তাদের কাছে যাওয়া কি নিষেধ। নিরাপত্তার ব্যবস্থা, মামলা এসব কি তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
নির্বাচনী এমন ঘটনায় একটা ভয় থেকে যায়, বিশেষ করে গরিবমৃত্যুর ক্ষেত্রে। লাশের মালিকানা চলে যায় পাশ করা পক্ষের কাছে। এমন মামলায় ভিকটিম হয় ফেল করা পক্ষের লোকজন। এটাও পুলিশের ব্যাপার। এটাও পুলিশই দেখবে। গরিবমৃত্যু বলতে দরিদ্র মানুষের এমন ঘটনায় লাশ হওয়া।
নিহত বাপ্পীদের বসবাস ১৩ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ চর্থা থিরা পুকুর পাড়। সে ধোপা পুকুর পাড়ের মৃত দুলাল চন্দ্র দাসের ছেলে। বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ সন্ধ্যায় নগরীর টিক্কারচর শশ্মানে তার অন্তেষ্টিক্রিয়া হয়। সবশেষ চিকিৎসা ঢাকায় হওয়ায় ওখানেই ময়নাতদন্ত হয়েছে।
অনেকদিন আহত হয়ে চিকিৎসার পর মারা গেলে মৃত্যু বা খুনের অভিযোগ শেষ হয়ে যায় না। ঢাকায় চিকিৎসা হলে ঘটনা লোকচক্ষুর দূরে চলে যায় সত্য কিন্তু হারিয়ে যায় না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটা অনেক বড় ব্যাপার। তাই বলে ওই ঘটনায় আহতের চিকিৎসাধীন মৃত্যু মামলা ছাড়াই শেষ হয়ে যাবে এটা আর যাই হোক সভ্যতা নয়। নিহতের পরিবার বিচার দাবি করেছে- যা এখন অনেক দূরের আশা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।