বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার গতি প্রকৃতিঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
।।মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।।
বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায় সব দেশ। এ চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক, এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু চাইলেই নিজ দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরা সহজ নয়। বিশ্বম-লে দেশকে তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন অভ্যন্তরীণভাবে সব কিছু গুছিয়ে নেয়া, নিজের সক্ষমতাকে তুলে ধরে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সূচকে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ঘটানো।
অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ বহুবিধ কারণে উন্নত দেশ বা বহুজাতিক সংস্থা হতে বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ মূলতঃ নিজস্ব যে সম্পদ আছে এবং বিনিয়োগ ও লেনদেন ভাসাম্যের জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন তার ফাঁক পূরণের লক্ষ্যে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণ করে থাকে। বৈদেশিক সহায়তা যে প্রকারভেদে গৃহীত হয় সেগুলো হল ঋণ ও অনুদান। ব্যবহারের দিক থেকে বৈদেশিক সহায়তা আবার তিন প্রকার যেমন, (ক) প্রকল্প সাহায্য (খ) পণ্য সাহায্য ও (গ) খাদ্য সাহায্য।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ১৯৭১/৭২ এ ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে বাংলাদেশের অনুকূলে ২৭০.৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনুদান হিসাবে ২৪৫.১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গৃহীত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট প্রতিশ্রুতি বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ছিল ৯.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ঋণ ৮.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও অনুদান হচ্ছে ০.৬৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে বিগত ৫৩ বছরে বৈদেশিক সহায়তা প্যাকেজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। দিন দিন অনুদানের পরিমাণ কমে এসেছে অন্যদিকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। যেখানে ১৯৭১-৭২ সময়কালে মোট বৈদেশিক সহায়তার ৯০.৫ শতাংশ ছিল অনুদান ও ৯.৫ শতাংশ ছিল ঋণ সেখানে ২০২২-২৩ সময়কালে অনুদান ও ঋণের পরিমান এসে দাঁড়িয়েছে মোট সহায়তার যথাক্রমে ৭.২ শতাংশে ও ৯২.৮ শতাংশে। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর হতে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত সময়কালে মোট ১৮০.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পর হতে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত সময়কালে ১২২.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করা হয়েছে, যার মধ্যে অনুদান ও ঋণের পরিমান ছিল যথাক্রমে ৩০.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ৯২.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (সূত্রঃ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের “বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ-২০২৩)।
ব্যবহারগত দিক থেকে জুন ৩০, ২০২৩ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি ১৮০.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর মধ্যে খাদ্য সাহায্য হিসাবে ৭.০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১১.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পণ্য সাহায্য, ১৫১.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকল্প সাহায্য এবং বাজেট সহায়তা হিসাবে ১১.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগৃহিত হয়েছে। অন্যদিকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অর্থের বিপরীতে ছাড়কৃত ১২২.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে খাদ্য সাহায্য বাবাদ ৭.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ব্যয়িত খাদ্য সহায্য বাবদ ১০.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ৯৪.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকল্প সাহায্য, ১০.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সার্পোট হিসেবে খরচ করা হয়েছে।
বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি উৎস সমূহের মধ্যেও দিনে দিনে পরিবর্তন এসেছে। সময়ের পরিক্রমায় দ্বি-পাক্ষিক উৎসের তুলনায় বহু পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী/সংস্থা হতে সহায়তা গ্রহণের হার বেড়েছে। ১৯৭১/৭২ সময়কালে দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী হতে প্রতিশ্রুতি সহায়তার পরিমাণ ছিল মোট সহায়তা ৮৫.৭ শতাংশ যেখানে ২০২২-২৩ সময়কালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মোট সহায়তা ৪৬.৭১ শতাংশে। অন্যদিকে এ সময়কালে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী/সংস্থার সহায়তার পরিমাণ ১৪.৩ শতাংশ (১৯৭১/৭২) হতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.২৯ শতাংশে (২০২২/২৩)। ব্যবহারের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় খাদ্য ও পণ্য সাহায্য অনেক পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে এবং প্রকল্প সাহায্যের ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৭২ সাল হতে ২০২৩ অবধি প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বিশ্বব্যাংক হতে (২৮.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক রয়েছে ২য় স্থানে (২২.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) এবং জাপানের অবস্থান হচ্ছে ৩য় (২০.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। চীন রয়েছে ৪র্থ স্থানে এবং রাশিয়া ৫ম স্থানে। ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮টি মুদ্রায় গৃহীত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে এসডিআর (৩৮.১%) (আইএমএফ এসডিআরকে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিনিময় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে), মার্কিন ডলার (৩৬.৪%), জাপানি ইয়েন (১৬.৭%), ইউরো (৩.৬%), চাইনিজ ইউয়ান (১.১%)।
ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশ্ব অংগনে বাংলাদেশের সুখ্যাতি রয়েছে। বাংলাদেশ কখনও ঋণের দায় পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। অভ্যন্তরীণ দায়ের তুলনায় বৈদেশিক দায় ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বেশকিছুটা জটিল ও স্পর্শকাতর। অভ্যন্তরীণ ঋণ সাধারণত বাজেটের দায় হিসাবে বিবেচিত হয় এবং সরকারি রাজস্ব আয় অথবা অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক দায় ব্যবস্থাপনা সরকারি রাজস্ব আয় ছাড়াও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের দায় বর্তায়। এটি পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপরেও একধরণের চাপ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ হচ্ছে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭৩.৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২২-২৩ এসে দাঁড়িয়েছে মোট ৭০.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার-যা জিডিপি’র প্রায় ১৫.৫৯ ভাগ। উল্লেখ্য যে, সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের ৮৮.১৮ ভাগই হচ্ছে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতির ঋণ। দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সূত্রে হতে প্রাপ্ত এসব মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বেশির ভাগই নমনীয় শর্তের আওতাধীন ঋণ। এ ধরণের ঋণের গড় গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে ৭.৫ বছর এবং ভারিত গড় পরিশোধকাল হচ্ছে ৩০ বছর। (সূত্রঃ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের “বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ-২০২৩)।
বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধের ব্যয় বাবদ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬৭১.৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে। যার মধ্যে আসলের পরিমাণ ছিল ১৭৪৪.৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সুদের পরিমাণ ছিল ৯২৭.০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক সংস্থাকে দিতে হয়েছে ১৭৮৬.১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিদের পরিশোধ করতে হয়েছে ৮৮৫.৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
উন্নয়ন সহযোগীদের অগ্রাধিকার ও কৌশলগত পরিবর্তন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা (সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারীর ধাক্কা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ), বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তাজনিত সংকট এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রের পরিবর্তন বৈদেশিক সহায়তা কার্যক্রমকে কঠিন হতে কঠিনতর করে তুলছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ঘাটতি মেটান, লেনদেনের ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে উন্নতর প্রযুক্তির হস্তান্তর, মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সমূহের জন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশীয় প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির দলিলাদি প্রণয়ন করে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। শুধু বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তিই নয়, প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার সঠিক ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার উপর আমাদের জোর দিতে হবে। বৈদেশিক সহায়তাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উন্নয়ন সামর্থ্য গড়ে তুলতে হবে, তবেই দীর্ঘমেয়াদে কাংখিত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
লেখক:অতিরিক্ত সচিব
বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন।