৭ম শ্রেণীতে ঝরে পড়তে যাওয়া সেই কিশোরী!

মহিউদ্দিন মোল্লা।।

রাশেদা আক্তার

বেতিহাটি। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। সেই গ্রামের মেয়ে রাশেদা আক্তার। বাবা মফিজুর রহমান। পেশায় কৃষক। তারা চার ভাই এক বোন। ওই গ্রামে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুনো মেয়েদের সংখ্যা কম। ১৯৭০সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। ১৯৮০সালে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। ১৯৮১সালে ভর্তি হন চার কিলোমিটার দূরে লাকসাম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজার পার হয়ে তাদের যেতে হতো স্কুলে, সাথে আরো দুইজন মেয়ে যেতো। সপ্তম শ্রেণীতে গিয়ে সাথের দুই মেয়ের একজন ঢাকায় চলে যায়। অন্যজনের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি একা হয়ে পড়েন। এদিকে তার সমবয়সী ১২-১৩ বছরের পাড়ার মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তাকে নিয়েও স্বজনদের উৎকণ্ঠার শেষ ছিলো না। তারা

বলতেন-‘মাইয়া গো লেয়াহড়া করাই কী লাভ। ডাক্তরি মাস্টরি তো আর কইত্ত ন্। ভাত রাইনবো আর হোলাইন হাইলবো। তাই যত হবেরে বিয়া দিয়া দেওন যায় ততো ভালা।’

স্বজনদের এমন কথা প্রায়ই তাকে শুনতে হতো। তবে তিনি পড়া চালিয়ে যাওয়ার জেদ ধরেন। মায়ের সমর্থন থাকায় বিয়ের পিঁড়িতে না বসে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। ঝরে পড়তে যাওয়া সেই কিশোরী এখন কুমিল্লা নগরীর নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নওয়াব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
তার পরিবারের সূত্র জানায়,পাশের গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় একা হয়ে গেলেও তিনি বুকে বই জড়িয়ে নিয়মিত স্কুলে গেছেন। ১৯৮৬সালে এসএসসি পাস করেন। তার মেঝ ভাই আজহারুল হক চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় চাকরি করেন। তার সাথে গিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। ১৯৮৮সালে এইচএসসি পাস করেন। ডিগ্রি পাশ করেন লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ থেকে। ১৯৯০সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয়। ১৯৯২সালে বিয়ে হয় ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুসের সাথে। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। পড়ালেখা,চাকরি,সংসার একসাথে চলতে থাকে। এমএ পাস করেন। বিএড,এমএড করেন। সুনামগঞ্জ পিটিআই স্কুলে চাকরি করেন। ১৯৯৭সালে যোগ দেন হবিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে। ১৯৯৮সালে আসেন কুমিল্লা নওয়াব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০০৫সালে বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন। যোগ দেন মুরাদনগর ডিআর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে কুমিল্লা জিলা স্কুল ও কুমিল্লা ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে যোগ দেন। ২০১১সালের ১০জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে।
রাশেদা আক্তার বলেন,১২-১৩বছরের বিয়ে হয়ে যাওয়া সহপাঠীরা শিশুই ছিলেন। সেই শিশুদের বিয়ের পর সন্তান সংসার সামলানো এক কঠিন যুদ্ধ ছিলো। তাদের পুষ্টিহীন চেহারা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। ৯ম শ্রেণীতে গিয়ে তার মনে হলো- তিনি থামতে চান না। বিশেষ করে লাকসামের মহিয়সী নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জীবন সংগ্রামও তাকে অনুপ্রাণিত করে। মা ও ভাইদের সহায়তা এগুতে পেরেছেন। এখন ক্লাসে মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের নিজের জীবনের সংগ্রামের গল্পও ফেলেন তিনি।
তিনি নারী শিক্ষার বিষয়ে বলেন,পথচলায় প্রতিকূলতা থাকবেই। তবে ধৈর্য্য সহকারে এগিয়ে যেতে হবে।
আনন্দের স্মৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়িয়েছি। তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেখলে জড়িয়ে ধরেন সালাম করেন। তখন মনটা ভরে যায়।
মহিয়সী নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর বিষয়ে তিনি বলেন, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তার নামে পদক চালু, তার জীবনী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
লাকসাম দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান দুলাল বলেন,তিনি একই গ্রামের বাসিন্দা। তিনি রাশেদা আক্তারের জীবন সংগ্রাম নিকট থেকে দেখেছেন। রাশেদা আক্তার নানা প্রতিকূল পরিবেশ মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। তিনি প্রত্যন্ত এলাকার নারী শিক্ষার অনুকরণীয় চরিত্র।