নেটওয়ার্কের বাইরে দুইদিন 

আল-আমিন কিবরিয়া।।
সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এ বনটি ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায়। বাকি অংশ ভারতে।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখতে কুমিল্লা থেকে জার্নালিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে আমাদের বুধবার দুপুরে যাত্রা। পথের যাত্রা বিরতি ঢাকায়। ভোরে আমাদের বাস বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে। বাসে যেতে যেতে দেখা হয় পদ্মা সেতু ও  জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এক্সপ্রেসওয়ের সৌন্দর্য। ৯ ঘন্টার বাস যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছে যাই মংলা ঘাটে৷
আমাদের যাত্রা সুন্দরবনের উদ্দেশ্য হলেও পরিবর্তন হয় সিদ্ধান্তের। সুন্দরবনের অদূরে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা একটি চরের নাম দুবলারচর৷ সেখানে তখন চলছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রাস উৎসব। একই সময় দুবলারচরে শুরু হয় শুটকি  আহরণের মৌসুম।
বৃহস্পতিবার বেলা তিনটা। মংলা ঘাট থেকে জাহাজে পশুর নদী হয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। যেতে যেতে দু’পাশে দেখা যায় নদী ও বনের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। নদীতে রাখা বিশালদেহী জাহাজ। কোনটি চলছে কোনটি আবার এংকার বসিয়ে থামিয়ে রেখেছে। মংলা ঘাটের কিছুটা দূর থেকেই শুরু হয়েছে সুন্দরবন। দেখা যায়, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য, সুন্দরী,  গরান, কেওড়া, গর্জন, বাইন আরও কত নাম না-জানা গাছে ঘেরা জঙ্গল। জাহাজ থেকে সেটি উপভোগ করেছি আমরা।
পশুর নদী হয়ে পৌঁছে যাই বলেশ্বর নদীতে৷  তখন আকাশ অন্ধকার। সরাসরি ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন আমরা। জাহাজ থামবে সুন্দরবনের গভীরে বলেশ্বর নদীর মাঝখানে। জায়গাটির নাম মরাখেজুরিয়া। জাহাজে রাতের খাবার শেষে আমাদের রাত্রিযাপন এখানে। ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দেখা যাক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। জাহাজ থেকে দেখা মিলল সুন্দরবনের হরিণের। জাহাজ থেকে দুইপাশে দেখা যায় বন। বনে হরিণ দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। উড়ে যায় নানা রঙের পাখির ঝাঁক।
নাস্তা শেষে আবার আমাদের যাত্রা শুরু ৷ বলেশ্বর নদী হয়ে পৌঁছে যাই শিবসা নদীতে। জাহাজ যতই সামনের দিকে যাচ্ছিল নদী ততই উত্তাল হয়ে উঠছিল। নদীর মোহনা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই বঙ্গোপসাগরে। মঙ্গলা ঘাট থেকে দুবলারচরে আসতে আমাদের সময় লাগে সাড়ে ১০ ঘন্টা।
মাঝ সাগরে থামিয়ে রাখা হয় জাহাজ। ছোট একটি নৌকা এসে আমাদেরকে নিয়ে যায় দুবলারচরে। দুবলারচরে গিয়ে দেখা যায়, এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। জন মানবহীন এই চরটিতে বসেছে হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলা। শুটকি আহরণ ও রাশ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ হাজার মানুষের সমগম। ঘুরে দেখা হয় এ চরটি।
দেখা যায়, রাধা কৃষ্ণের আগমন উপলক্ষে এই চরে শত বছর ধরে হচ্ছে উৎসব। এসবকে কেন্দ্র করে রাধা কৃষ্ণের হাজার হাজার ভক্ত। আর তাদের আগমন উপলক্ষে বসেছে মেলা। মেলায় রকমারি খাবার, প্রসাধনী, খেলনাসহ বিক্রেতাদের হাঁক ডাকে মুখর চারপাশ।
শুটকি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, পল্লীতে তৈরি হয়েছে বাঁশ খড় দিয়ে অস্থায়ী দোকান। দোকানে পাওয়া যায় একটি ঘরের যাবতীয় সবকিছু। এ চরে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে শুটকির আর অনেক কাজ। ৭০০ সরদারের অধীনে শুটকি আহরণের কাজ করেন অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক।
বিকেল পর্যন্ত ঘুরে আবার চলে আসি জাহাজে। জাহাজে দুপুরের খাবার শেষে বের হই দুবলারচরের সমুদ্র বিচে। সমুদ্রের বিচে ঘুরে মনে জেগে উঠেছে এক দারুণ অনুভূতি। বঙ্গোপসাগরের এই পাড়টিতে ঘুরলে মনে হবে এ যেন দ্বিতীয় সেন্টমার্টিন। রাত্র ১০ টা পর্যন্ত ঘুরে ফিরে আবার চলে আসি জাহাজে। খাওয়া শেষে জাহাজের ছাদে বসে গানের আসর। রাত ১২টা পর্যন্ত চলে এই গানের আসর। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার জাহাজ এই রাত্রি যাপন।
শনিবার ভোর পাঁচটা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের গঙ্গাস্নান দিয়ে শেষ হবে রাস উৎসব। উৎসবটি দেখতে আমরা বের হই স্পিডবোর্ড নিয়ে। দেখা শেষ হলে আবার ফিরে আসি জাহাজ। শেষে আমাদের জাহাজটি ছেড়ে আসে  করমজলের উদ্দেশ্যে। করমজল সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের একটি অংশ। এটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এখানেই রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র। ঘুরতে গেলে অনেকটা চিড়িয়াখানার মত লাগে করমজল। এখানে দেখা মিলবে বন্য মুক্ত বানর। ঘুরে দেখা হয় আমাদের এ অংশটি। ঘুরাঘুরি শেষে আবার চলে আসি জাহাজে।  আমাদের আবার যাত্রা মঙ্গলা ঘাটের উদ্দেশ্যে। মঙ্গলাঘাট বাসে ঢাকা হয়ে রাত সাড়ে ১১টায় কুমিল্লায় ফেরা।
এই ভ্রমণে সহযোগিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিমের প্রতি। তার আতিথেয়তা হৃদয়ে দাগ কেটেছে।
লেখক: সংবাদকর্মী।
inside post
আরো পড়ুন