বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের মিডিয়ার অপপ্রচার

সত্যের মুখোমুখি মিথ্যার মুখোশ
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ভূমিকা
গণমাধ্যম জাতির চেতনা। কিন্তু যখন এই মাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সত্যকে আড়াল করে, তখন সেটি তথ্য নয়, অপপ্রচার হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেশী ভারতের কিছু প্রভাবশালী গণমাধ্যম বারবার বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে, তা কেবল সাংবাদিকতার নৈতিকতাই লঙ্ঘন করছে না, বরং দুই দেশের সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
অপপ্রচারের কয়েকটি দৃষ্টান্ত
১. হিন্দু নির্যাতন নিয়ে অতিরঞ্জন (২০২১)
২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের কিছু এলাকায় সংঘটিত বিচ্ছিন্ন সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ভারতের কিছু গণমাধ্যম যেমন Zee News, Republic TV, OpIndia ইত্যাদি শিরোনাম করেছিল “বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যা”।
অথচ বাংলাদেশ সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, ১০০টিরও বেশি মামলা হয় এবং দোষীদের গ্রেফতার করা হয় (সূত্র: The Hindu, Oct 2021)।
এই ঘটনার পর ভারতেই ত্রিপুরা রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী “বাংলাদেশ সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত খবর অনেকটাই গুজব ও অতিরঞ্জন” (সূত্র: The Wire, Nov 2021)।
২. বাংলাদেশি ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশকারীর প্রচার ও NRC বিতর্ক
ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি ঘিরে কিছু মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করে—বাংলাদেশ থেকে নাকি লাখ লাখ ‘অবৈধ মুসলিম’ ভারতে ঢুকে পড়েছে। এমনকি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের “ঘুসপোকা” বলেও আখ্যা দেন (সূত্র: Al Jazeera, Dec 2019)।
বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এই মন্তব্যকে ‘অমার্জনীয় ও অসম্মানজনক’ বলে প্রতিবাদ জানায়।
৩. চীন-পাকিস্তান প্রোপাগান্ডা ও ভ্রান্ত বিশ্লেষণ
সম্প্রতি ভারতের একাধিক মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে “চীনের উপনিবেশিক দখল” হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে।
অথচ বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে সুস্পষ্টভাবে বলেছে—“বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে, শত্রু কারো সঙ্গে নয়” (সূত্র: Dhaka Tribune, Jan 2022)।
চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গেও প্রায় ২২টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং ত্রিপুরা সীমান্তে বানিজ্যিক কার্যক্রম জোরদার করেছে (সূত্র: Indian MEA Reports)।
বাংলাদেশের বাস্তবতা যা ভারতীয় অপপ্রচারে উপেক্ষিত
UNDP-এর ২০২৩ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অগ্রসর রাষ্ট্র।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের রিপোর্টে বলা হয়, “বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।”
WEF’s Gender Gap Report অনুযায়ী, বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে শীর্ষে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অবদানকারী দেশ (সূত্র: UN Peacekeeping, 2023)।
এই অপপ্রচার কেন?
১. রাজনৈতিক কৌশল: ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা ঢাকতে বহিরাগত ‘শত্রু’ তৈরি।
২. হিন্দুত্ববাদ প্রচারণা: সংখ্যালঘু বিদ্বেষকে উসকে দেওয়ার হাতিয়ার।
৩. ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ভয় পায় ভারতীয় রক্ষণশীল গোষ্ঠী।
৪. মিডিয়া পলিউশন: তথ্য যাচাই ছাড়াই চটকদার খবর ছাপানো ও দর্শক বাড়ানোর উদ্দেশ্য।
প্রতিবাদ এবং করণীয়
বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ করেছে, তবে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে আরও সোচ্চার হতে হবে।
ফ্যাক্টচেকিং, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও তথ্য নিরীক্ষার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
ভারতীয় জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হতে পারে আমাদের দেশের এবং প্রবাসের সাংবাদিকরাই।
এবং, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে সোচ্চার ও তথ্যনির্ভর ডিজিটাল লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে।
উপসংহার
সত্য কখনো মুছে যায় না। মিথ্যার প্রচার যত শক্তিশালী হোক, তথ্যের আলো একদিন সব ভ্রান্তি ভেদ করেই সামনে আসে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র—রাজনৈতিক সীমারেখা থাকলেও সংস্কৃতি, সম্পর্ক এবং ইতিহাসে আমরা একই বন্ধনীতে।
আমরা চাই, গণমাধ্যম হোক সত্যের ধারক। আর প্রতিবেশী হোক পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যের ভিত্তিতে।
তথ্যসূত্র:
১. The Hindu – Oct 2021: “Bangladesh communal violence”
২. The Wire – Nov 2021: “Tripura Police Busts Bangladesh Misinformation”
৩. Al Jazeera – Dec 2019: “Amit Shah’s comments draw criticism”
৪. Dhaka Tribune – Jan 2022: “Foreign policy vision of Bangladesh”
৫. UNDP Human Development Index – 2023
৬. World Bank Report – 2024
৭. UN Peacekeeping Contribution Data – 2023
৮. WEF Gender Gap Report – 2023
৯. Indian Ministry of External Affairs Reports – 2023
বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটি সম্পূর্ণ তথ্যভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসরণ করে রচিত হয়েছে। লেখকের উদ্দেশ্য কোনো দেশের সম্মানহানি নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সত্য প্রতিষ্ঠা।
inside post
আরো পড়ুন