উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে—বাস্তবতা নাকি ব্যঙ্গচিত্র?

মনোয়ার হোসেন রতন।।
অনেক দিন ধরেই দেশের মানুষ একটি স্লোগান শুনে এসেছে—“উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশ ভাসছে।” এই বাক্যটি রাজনৈতিক বক্তৃতা, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড কিংবা পোস্টারে এতটাই ব্যবহৃত হয়েছে যে, যেন এটি উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠেছিল। মানুষ ভেবেছিল, এই “জোয়ার” বুঝি উন্নতির প্রতীক, উন্নত অবকাঠামোর প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে—এসবই বুঝি সেই জোয়ারের ফল। কিন্তু আজকাল ঘুম ভাঙলেই দেখা যায়, বাড়ির বারান্দা থেকে শুরু করে অফিসের গেইট পর্যন্ত knee-deep বা কখনো waist-deep পানি।
আসলেই কি উন্নয়নের জোয়ার বুঝাতে চেয়েছিল? না কি এটি ছিল ভবিষ্যৎ এক রূঢ় ব্যঙ্গচিত্র?
বর্তমান সময়ে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের নানা শহরে কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ড্রেনেজ ব্যবস্থা যেন ব্যস্ততম মেগাসিটির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। “পানির উন্নয়ন” এতটাই অগ্রসর যে, অনেক এলাকায় জরুরি বোর্ডিং পাস ছাড়া ঘরে ঢোকা যাচ্ছে না! যেন হাউজবোটে বাস করছে নগরবাসী। কেউ কেউ ঘর থেকে অফিসে যাচ্ছেন ভ্যানে, আবার কেউ ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছেন নৌকায়। ডেলিভারি বয় এখন শুধুই খাবার নয়, পানি ডিঙানোর অভিজ্ঞতাও বয়ে আনছে।
একসময় নদীভাঙনে মানুষ ভেসে যেত, এখন শহরের ভিতরেই মানুষ প্রতিনিয়ত ভাসছে। উন্নয়নের ছোঁয়া পেতে গিয়ে জনগণ যেন বন্যার শিকার হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ, অফিসগামী মানুষের চেহারায় আতঙ্ক, ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ—সব মিলিয়ে যেন এক পানিভিত্তিক দুর্যোগ।
সবচেয়ে মজার এবং করুণ দিক হলো—যে এলাকাগুলোকে ‘উন্নত’ বলা হয়, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ডুবে যায়। উত্তরার কোনো ব্লক, বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলনার সোনাডাঙ্গা কিংবা সিলেটের জিন্দাবাজার, কুমিল্লা —সব জায়গা যেন একেকটা “স্মার্ট ডুব অঞ্চল”! “উন্নয়ন আগে নামে না, ভাসে”—এ কথা আজ বাস্তব সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
সরকারি ভাষণে উন্নয়নের বহর চোখে পড়ে, কিন্তু সেই উন্নয়নের পরিপূর্ণতা বা টেকসই ব্যাখ্যা কোথায়? জলাবদ্ধতার এই চিত্র কি একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ বা উন্নত বাংলাদেশের পূর্বাভাস দিতে পারে?
উন্নয়নের সংজ্ঞা কি কেবল ইট, বালি, কংক্রিট আর ঝলমলে রাস্তা?
নাকি এটি হওয়া উচিত একটি ভারসাম্যপূর্ণ, পরিকল্পিত এবং নাগরিকবান্ধব কাঠামো, যেখানে মানুষ পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পায়?
আজ ‘উন্নয়ন’ মানে যেন চোখ ধাঁধানো প্রকল্প, ফিতা কাটা অনুষ্ঠান, ড্রোন দিয়ে ভিডিও তোলা আর রাতারাতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবি। কিন্তু নীচে কী আছে? সেখানে আছে পচা পানি, অচল ড্রেন, নাক-চেপে চলা মানুষ আর বিকল নগর জীবন। এই জোয়ারের নীচে চাপা পড়ছে নাগরিক জীবনের বাস্তবতা।
আরেকটি দুঃখজনক দিক হলো—এত সমস্যা, অথচ দায়িত্বশীলদের বক্তব্যে যেন এই দুর্যোগ কেবল আবহাওয়ার খেয়ালখুশি। তারা বলেন, “এটি স্বাভাবিক”, “বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে কিছুটা সময় লাগবে।” অথচ পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ, এবং বালু দিয়ে ড্রেন বন্ধ করে দেওয়াই আসল কারণ—তা কেউ স্বীকার করতে চায় না। যেন দায়িত্বজ্ঞান হারিয়ে গেছে পানির স্রোতে।
নাগরিকদের চোখে এই “উন্নয়নের জোয়ার” এখন উপহাসের প্রতীক। মানুষ এখন বলে, “দেশ আসলেই ভাসছে, তবে পানি আর দুর্ভোগে!”
সত্যি বলতে কি, জোয়ার শব্দটির সঙ্গে থাকে আশার প্রতীক, সমৃদ্ধির ইঙ্গিত। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই শব্দটি হয়ে উঠেছে এক বিষাদময় ব্যঙ্গ—যেখানে উন্নয়নের চশমায় দেখা যাচ্ছে কেবল দুর্যোগ, দুর্ভোগ আর ডুবে যাওয়া এক শহর।
তাই এখন প্রয়োজন জলবুদ্ধির, শুধু উন্নয়নের নয়। উন্নয়নের নামে যেন আর কেউ ডুবে না যায়। এই জোয়ারে না ভাসি, বরং দাঁড়াই টেকসই উন্নয়নের মাটিতে।
না হলে একদিন “ভেসে যাওয়া উন্নয়ন” নিয়ে রচিত হবে ইতিহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর ব্যর্থতার দলিল!
inside post
আরো পড়ুন