সম্ভাবনার চট্টগ্রাম বন্দর

মনোয়ার হোসেন রতন।।
চট্টগ্রাম বন্দর—বাংলাদেশের অর্থনৈতিক হৃদস্পন্দন, যাকে বলা হয় দেশের Gateway to the World। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আজ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে। সময়মতো পণ্য পরিবহন, কার্যকর অপারেশন, আধুনিক সরঞ্জাম ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্দরটি দিন দিন তার সক্ষমতা হারাচ্ছে। আমাদের একটি বড় ভুল হলো—আমরা আবেগ দিয়ে ভাবি, তথ্য দিয়ে নয়। আমরা ভাবি বন্দরে বিদেশি অংশগ্রহণ মানেই সার্বভৌমত্ব হারানো। অথচ বাস্তবতা হলো—আধুনিকতা ও দক্ষতা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ নেই।
সময়ক্ষেপণ: দুনিয়ার সবচেয়ে ধীরগতির পোর্টগুলোর একটি
বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে ৩৩৪তম স্থানে। জাহাজগুলোকে গড়ে ২.৭ দিন ঘাটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, যেখানে উন্নত বন্দরে এই সময় এক দিনেরও কম। এতে আমদানি-রপ্তানির চেইন ব্যাহত হয়।
টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম (জাহাজ আসা থেকে ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত সময়) চট্টগ্রামে ৩.২৩ দিন—যেখানে বিশ্বমানের বন্দরে এটি মাত্র ১.৫ দিনের নিচে। এর অর্থ হলো, চট্টগ্রামে একই জাহাজ গড়ে ২ গুণ বেশি সময় আটকে থাকে, যা পণ্য খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয়।
অপারেশনাল অদক্ষতা ও যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা
বন্দরের ক্রেনগুলো ঘণ্টায় গড়ে ১৫-২০টি কনটেইনার স্থানান্তর করতে পারে, যেখানে কলম্বোতে তা ২৫-৩০ এবং গুজরাটে ২০০-রও বেশি।
একটি ঘাটে সম্মিলিতভাবে ঘণ্টায় ৩৫টি কনটেইনার হ্যান্ডেল হয়, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ভয়াবহ রকম কম। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদারি, এবং অব্যবস্থাপনার ফলে কর্মদক্ষতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ডিউয়েল টাইম: ব্যবসার জন্য মৃত্যুঘণ্টা
চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য জাহাজে ওঠাতে গড়ে ১১ দিন লেগে যায়, যেখানে ভিয়েতনামে এই সময় ৫-৭ দিন এবং কলম্বোতে ৭-৮ দিন। এই বিলম্বের ফলে বাংলাদেশ প্রতিটি রপ্তানি অর্ডারে গড়ে ৪-৬ দিন পিছিয়ে থাকে—যা সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ক্রেতা সন্তুষ্টিকে ব্যাহত করে।
কাঠামোগত দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের জাল
চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট, যারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে। ন্যূনতম দামে টেন্ডার দিয়েও যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে, সিন্ডিকেটপন্থী অপারেটররা বছরের পর বছর ধরে অদক্ষভাবে বেশি খরচে কম কাজ করে যাচ্ছে। এর ফলে উন্নয়ন না হয়ে দুর্নীতি পুষ্ট হচ্ছে।
বিদেশি অপারেটর মানেই বন্দর বিক্রি নয়
বিদেশি অপারেটর মানেই সার্বভৌমত্ব বিক্রি নয়—এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। সিঙ্গাপুর, মরক্কো, কলম্বো, ভিয়েতনাম—সব দেশেই বিদেশি অপারেটর ব্যবস্থাপনা করে, কিন্তু অবকাঠামোর মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের হাতে। দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বন্দরের গতি, স্বচ্ছতা এবং প্রতিযোগিতা বাড়ানো সম্ভব।
সম্ভাবনার বাস্তব চিত্র
বিশ্লেষকদের মতে, যদি দক্ষ অপারেটরদের হাতে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে:
পোর্ট অকুপেন্সি ৮০% থেকে কমে ৬০%-এ নামবে।
রপ্তানি পণ্যের গেট-টু-শিপ টাইম ২২ দিন থেকে কমে ৯ দিনে আসবে।
ব্যবসায়ীদের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে।
একজন সাহসী কণ্ঠ আশিক চৌধুরী এ অচলায়তনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তিনি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, দক্ষ অপারেটর এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনার পক্ষে কথা বলেন।
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। এখানে আবেগ নয়, প্রয়োজন তথ্যনির্ভর সাহসী সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ কোনো অপরাধ নয় বরং তা হতে পারে উত্তরণের পথ। আধুনিকতা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর টিকবে না, এবং এর পরিণতিতে দেশের রপ্তানি বাজার ধসে পড়বে। এখন সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার—কান্না নয়, কার্যকর কৌশলই আমাদের পথ দেখাবে।
তথ্যসূত্র:
World Bank CPPI Index 2023: Container Port Performance Index
The Business Standard, June 2023: Chattogram port’s vessel turnaround time 3.23 days
UNCTAD Liner Shipping Connectivity Index, 2023
Maritime Gateway, South Asia Port Review 2023
Interviews: Logistics experts & operators, Chittagong Port Users Forum
