জীবন যেখানে যেমন

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
জীবন—এ শব্দটি ছোট, কিন্তু এর গভীরতা অসীম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ শব্দটির ব্যাখ্যা যেন প্রতিটি মানুষের কাছে আলাদা। এখানে জীবন কারো কাছে সকালবেলার খালি পেটে স্কুলে যাওয়া, আবার কারো কাছে বিলাসবহুল গাড়িতে বসে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার গল্প। কেউ দিনমজুরির টাকা হাতে নিয়ে বাজারে গিয়ে হিসেব মিলাতে পারেন না, আর কেউ অনলাইনে বিলাসী পণ্য কিনে ভিন্ন রকম অসন্তুষ্টি পুষে রাখেন নিজের ভেতরে। এমনই বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তবতার নাম—আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের পথে থাকলেও, সমাজের প্রতিটি স্তরে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া সমভাবে পৌঁছায়নি। শহর আর গ্রামের জীবনধারা এখনও আকাশ-পাতালের ফারাক। একদিকে রাজধানী ঢাকা কিংবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আধুনিক জীবনের রঙিন বিজ্ঞাপন, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে এখনো বিদ্যুৎহীন সন্ধ্যা, নিরাপদ পানির অভাব, কিংবা একটি টিউবওয়েলের জন্য পুরো পাড়া-পড়শির লাইন। জীবন তাই কোথাও আরাম, কোথাও অভাব—সবমিলিয়ে এক বৈপরীত্যের চিত্রপট।
শিক্ষা খাতে উন্নতি দৃশ্যমান হলেও সুযোগের বন্টনে বৈষম্য প্রকট। ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষক, প্রযুক্তি নির্ভর পাঠদান—এসব শহরে বেশি, অথচ গ্রামের প্রতিভাবান শিশুরা এখনও কাঁদে একটি বই বা পেনসিলের অভাবে। ফলে জীবন যেমন সেখানে, তেমনই থেকে যায়: ক্ষুধার্ত স্বপ্ন, সীমিত সম্ভাবনা।
শ্রমজীবী মানুষের জীবন তো বটেই, মধ্যবিত্তের অবস্থাও আজ ক্রমেই সংকটে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, চিকিৎসা ব্যয়, বেকারত্ব, আর নিরাপত্তাহীনতায় তাদের জীবনে শ্বাস নেয়ার ফাঁকটুকু যেন কমে এসেছে। অথচ এ শ্রেণিটিই দেশের চালিকাশক্তি, নীতিনির্ধারকদের করদাতা, এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা।
নারী সমাজের অবস্থান বদলাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সমাজিক-মানসিক কাঠামোর অনেক শেকড় এখনও পুরুষতান্ত্রিক। একজন নারী আজ কর্মজীবী, শিক্ষিত, উদ্যোক্তা, তবু তাকে শোনতে হয়—‘তোমার জায়গা রান্নাঘরে!’ অথচ এ নারীই সংসার চালায়, সন্তান গড়ে তোলে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তার জীবন যেমন—সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর অসীম সাহসের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম একদিকে প্রযুক্তিতে আগ্রহী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়, আবার অন্যদিকে চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়ানো দীর্ঘ মানবস্রোতের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট হাতে নিয়েও কেউ কেউ দিনমজুরের পেশা বেছে নেয় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে জীবন যেমন—তেমনই এক অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা, যেখানে প্রতিভা হারিয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।
স্বাস্থ্যখাত, কৃষি, পরিবেশ—সবখানে উন্নয়নের গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে অব্যবস্থাপনার দীর্ঘ ছায়া। অনেক হাসপাতালে গিয়ে মানুষ চিকিৎসা পায় না, সরকারি কৃষিনীতির সুফল প্রান্তিক কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না। জীবন তখন অসহায়, হাহাকারময়, অথচ সেই জীবনের মাঝেই মানুষ ফেরে মাঠে, ফেরে কাজে, হাসে সন্তানের মুখে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারও সাধারণ মানুষের জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। ক্ষমতাবানদের জীবনে সুযোগের পাহাড়, আর অসহায় মানুষের জীবনে আইনের ফাঁক! জীবন কোথাও নির্ভীক, কোথাও শোষিত। কোথাও যেন স্বাধীন, আবার কোথাও পরাধীন।
তবুও এই দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে এক আশ্চর্য জেদ আছে—টিকে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার, নতুন ভোর দেখার। একজন রিকশাচালক ভোর ৫টায় বের হন রাস্তায়, একজন শিক্ষিকা গ্রামের শিশুর মুখে স্বপ্ন গেঁথে দেন, একজন মা নিজের মুখে তুলে না দিয়ে সন্তানকে খাওয়ান। জীবনের সংজ্ঞা তাই এখানে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগ, দায়িত্ব ও ভালোবাসার অন্যরকম বুনন।
বাংলাদেশের জীবনের এ চিত্রপট আমাদের মনে করিয়ে দেয়—‘জীবন যেখানে যেমন’, সেখানে তেমন করেই লড়াই চলে, বেঁচে থাকা চলে, স্বপ্ন বোনা চলে। কেউ দাঁড়ায় আকাশ ছোঁয়ার জন্য, কেউ দাঁড়ায় শুধুই পেটের ক্ষুধা মেটাতে। এ দেশেই জীবন কখনো গদ্যময় কবিতা, কখনো হাহাকার, কখনো বা নীরব কষ্টের অগোচর নদী।
তাই প্রয়োজন এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যেখানে জীবন “যেমন” নয়—বরং “যেমন হওয়া উচিত” সে জায়গায় পৌঁছাতে পারে। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে, ন্যায়বিচার থাকবে, মানবিকতা থাকবে।
কারণ দিন শেষে—জীবনে তো সবাইকেই বাঁচতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে—কীভাবে?
