নৈতিকতার নাবিক ড. ইউনুস


মনোয়ার হোসেন রতন।।
যখন পৃথিবী অর্থনীতির নামে বৈষম্যকে নীতিতে রূপ দেয়, তখন মানবিক বিকল্পের ভাষা খুঁজে ফিরি আমরা। ঠিক এমন এক সন্ধিক্ষণে, ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের শান্ত পাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস—যাঁর ভাবনা আজও সময়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে, “উন্নয়ন কার, কীসের জন্য?”
ক্ষুদ্রঋণ: পুঁজিবাদের প্রান্তে মানবিক বিপ্লব
শুধু তত্ত্ব নয়, প্রয়োগের ভেতর দিয়েই ড. ইউনুস এক নতুন দিগন্তের পথিক হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বকে শিখিয়েছেন—ধনী হওয়ার জন্য নয়, দরিদ্রকে মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতেই অর্থনীতির হাত ধরতে হয়।
ক্ষুদ্রঋণ কেবল টাকা নয়, এটি ছিল আত্মমর্যাদার এক সুতো—যা সম্পদহীন নারীকে দাঁড় করায় স্বাবলম্বিতার প্রতিমূর্তি করে। আজ বিশ্বের শতাধিক দেশে এই মডেল প্রয়োগ হচ্ছে, যার শিকড় গাঁথা বাংলাদেশের মাটিতে।
সোশ্যাল বিজনেস: নৈতিক মুনাফার দর্শন
পুঁজিবাদ যেখানে মানুষকে পণ্য বানায়, সেখানে ইউনুস সমাজকে ব্যবসার উদ্দেশ্য বানিয়েছেন। তাঁর উদ্ভাবিত “সোশ্যাল বিজনেস” ধারণা পৃথিবীকে বলেছে—উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু ধনী হওয়া নয়, পরিবর্তনের কারিগর হওয়াও বটে।
এখানে মুনাফা নয়, সমস্যার সমাধানই ব্যবসার উদ্দেশ্য। উদ্যোক্তা মূলধন ফেরত পান, কিন্তু লাভ নয়—এটাই মানবিক পুঁজিবাদের নবজন্ম।
নৈতিক শক্তির জয়যাত্রা
ড. ইউনুসকে নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০৬), প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯), কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০) এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১২ জুন ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়।
এই সম্মান কেবল ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের নৈতিক উচ্চতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
অন্তর্বর্তী সরকার: নীতির প্রতিষ্ঠা
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. ইউনুস।
এটি প্রশাসনিক দায়িত্বের চেয়ে বেশি—একটি জাতির নৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। নীতিনির্ভর নেতৃত্বের এই প্রত্যাবর্তন ইতিহাসের এক গর্বিত অনুরণন।
সমালোচনার মুখেও সত্যের দীপ্তি
সমালোচনা এসেছে—ব্যাংকের মালিকানা, সুদের হার বা তাঁর অবস্থান নিয়ে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র যদি স্বার্থান্ধ রাজনীতির ভেতর নিমজ্জিত থাকে, তাহলে বিকল্প কণ্ঠস্বর কি রাষ্ট্রদ্রোহী হবে? না কি সেই কণ্ঠই হবে নতুন পথের দিশারি?
ইউনুস: ভবিষ্যতের বিকল্প
যখন বিশ্ব আবার মুনাফা-নির্ভর “নয়া-উপনিবেশবাদ”-এর ফাঁদে, তখন ইউনুস স্মরণ করিয়ে দেন—উন্নয়ন মানে প্রবৃদ্ধি নয়, মানবিকতা।
জাতিসংঘের SDGs ও ইনক্লুসিভ গ্রোথ ধারণার বহু আগেই তিনি সেই পথ দেখিয়েছেন।
একটি জন্মদিন, একটি দায়
২৮ জুন—ড. ইউনুসের জন্মদিন কেবল শ্রদ্ধা জানানোর উপলক্ষ নয়, বরং তাঁর আদর্শে দায়বদ্ধতার প্রতীক।
নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতার আসন নয়—নৈতিকতার জ্যোৎস্নায় পথচলার সাহস।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস কেবল একজন অর্থনীতিবিদ নন, বরং সময়ের অন্তর্বর্তী সংকটের এক মানবিক উত্তর।
তাঁর পথ পরিত্যক্ত হলে আমরা হারাব ভবিষ্যতের এক বিকল্প স্বপ্ন।
“যাঁরা ভিন্নভাবে চিন্তা করেন, তাঁরাই বদলে দেন দৃষ্টিভঙ্গির মানচিত্র। ড. ইউনুস তাঁদেরই একজন—নৈতিক বিকল্পের এক আলোকবর্তিকা।”