গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ও কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়

এক বিস্মৃত পথিকৃতের ইতিহাস

।। মনোয়ার হোসেন রতন ।।
একটি জাতির উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোর আধুনিকতায় নয়, তার অতীতকে কতটা সযত্নে ধারণ করতে পারে, সেটার উপরও নির্ভর করে। ইতিহাসের পাতায় অনেক মনীষীর নাম থাকে না, কারণ তাঁরা প্রচারের আলো খুঁজেননি—তাঁরা কাজ করে গেছেন নিভৃত নির্জনে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব, সেই আলোকিত কর্মযোদ্ধাদের যথাযোগ্য সম্মান ও স্মরণে রাখার। ঠিক এমন একজন মানুষ হলেন সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষানুরাগী গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, যিনি কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রকৃত স্থপতি হলেও, আজ তাঁর নাম প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেস্টা চলছে। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লায় নারী শিক্ষার একটি দৃঢ় ভিত্তি রচনা করে কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। এই প্রতিষ্ঠান আজ হাজারো নারী শিক্ষার্থীর স্বপ্নপূরণের যাত্রাপথ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গোলাম মোস্তফা চৌধুরী-ই ছিলেন এ উদ্যোগের অন্যতম প্রণেতা। সামাজিক প্রতিকূলতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং অর্থনৈতিক সংকটে যখন প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা করা দুঃসাধ্য কাজ ছিল, তখন তিনি একক উদ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সংগঠিত করেন, দান সংগ্রহ করেন এবং প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন।
তাঁর এই মহান উদ্যোগের পেছনে ছিল এক প্রগাঢ় দর্শন—
“একটি শিক্ষিত নারী মানে একটি শিক্ষিত পরিবার, আর একটি শিক্ষিত পরিবার মানেই একটি উন্নত সমাজ।”
গোলাম মোস্তফা চৌধুরী শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না—তিনি ছিলেন চিন্তার প্রজ্জ্বলিত দীপ। দৈনিক ইত্তেফাকের কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতা ছিল নির্ভীক ও জনমুখী। ষাট-সত্তরের রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকে, বিশেষত ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর লেখনী হয়ে উঠেছিল গণমানুষের কণ্ঠস্বর। তথ্যনিষ্ঠতা, ভাষার শুদ্ধতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল।
তাঁর আরেক পরিচয় ছিল সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে। নাটক, আবৃত্তি, সংগীত, কবিতা ও চিত্রকলায় তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। তিনি বিশ্বাস করতেন—”শিক্ষা যদি মনন গঠন করে, সংস্কৃতি হৃদয় তৈরি করে।” তাঁরই প্রচেষ্টায় বহু তরুণ-তরুণী তখন শিল্প-সাহিত্যে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
তাঁর স্বপ্ন ছিল, শিক্ষার পাশাপাশি একটি মানবিক ও মুক্তচিন্তার সমাজ গড়ে তোলা। সেই কারণে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গঠন থেকে শুরু করে তার পাঠ্যক্রম, সহশিক্ষা কার্যক্রম, এমনকি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিও সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
কিন্তু আজ?
আজকের প্রজন্ম তাঁকে চিনে না। প্রতিষ্ঠান যাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর ছবি নেই দেওয়ালে, নাম নেই প্রণেতা হিসেবে। বরং তাঁর অবদানকে কেউ কেউ সচেতনভাবেই অস্বীকার করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। যদিও ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত ‘বিচিত্র বর্ণিল গোলাম মোস্তফা চৌধুরী’ নামক স্মারকগ্রন্থে তাঁর জীবনের নানা দিক যেমন উঠে এসেছে, তেমনই সেখানে স্পষ্টভাবে তাঁর শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এখনই সময়
এই অবমাননা শুধরে দেওয়ার এখনই সময়। ইতিহাসকে তার সত্যিকার রূপে প্রকাশ করার জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রাঙ্গণে একটি স্মারক ফলক, একটি ভবনের নামকরণ বা একটি স্মৃতি কর্নার তাঁর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধার নিদর্শন হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে অবশ্যই তাঁর অবদানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।
কারণ ইতিহাস কোনোদিন মিথ্যা ভুলে থাকে না। ইতিহাস বরং তার নিজের পথে ফিরে আসে, সত্যকে ফিরিয়ে আনে—আর তখন যারা সেই সত্যকে অস্বীকার করেছে, তারা নিজেদের দাঁড় করাতে পারে না বিবেকের আদালতে।
শেষ কথা
গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ কর্মী, যিনি শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য স্বপ্ন দেখতেন। কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয় তাঁর সেই স্বপ্নের মূর্ত রূপ। আমরা যদি তাঁর নাম ভুলে যাই, তাঁর স্বপ্নকে অসম্মান করি।
আজ আমরা যদি চুপ থাকি, আগামী প্রজন্ম আমাদের প্রশ্ন করবে—
“তোমরা কেন ইতিহাস বিকৃত করলে? কেন যারা আলো জ্বেলেছিল, তাঁদের নাম নিভিয়ে দিলে?”
আমরা যেন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি—সেই চেষ্টা, সেই ন্যায্যতার পথে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের বর্তমান দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র:
দৈনিক ইত্তেফাক (আর্কাইভ),
কুমিল্লা প্রেস ক্লাব নথিপত্র,
২০২৪ সালে প্রকাশিত “বিচিত্র বর্ণিল গোলাম মোস্তফা চৌধুরী” স্মারকগ্রন্থ, পারিবারিক ও সাংবাদিক সাক্ষাৎকার, সাবেক শিক্ষক ও সহকর্মীদের বয়ান।