জুতা চোরের আত্মা ও জাতির ভাগ্য

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশে রাজনীতি এখন আর জনগণের সেবামূলক কার্যক্রম নয়, বরং একধরনের শিল্প—যার নাম ‘চোরামি’। এখানে প্রতিযোগিতার মূল শর্ত একটাই: কে কত বড় চুরি করতে পারে ধরা না পড়ে!
এক সময় পাড়া-মহল্লায় যে ছেলেটি মসজিদের সামনে রাখা জুতা টিপ টিপ করে সরিয়ে দিত, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিতে যার উত্থান—তাকেই দেখেছি গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রেস কনফারেন্সে ঘোষণা দিতে, “আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে আছি।” অথচ সেই ঘোষণার ফাঁকেই পিছনের দরজা দিয়ে বাজেট, প্রকল্প, এমনকি দেশের ভাবমূর্তিও উধাও হয়ে যায়। পকেটের দৈন্য আমাদের বলে দেয়, দুর্নীতি কতটা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গিয়েছিল।
আজ এ দেশে চুরি যেন এক পেশাদার শিল্প। কেউ ভোট চুরি করে, কেউ ব্যাংক লুট, কেউ আবার ইতিহাস চুরি করে নিজের জীবনীতে বীরত্বের গল্প লিখে। শিক্ষা, প্রশাসন, আইন-আদালত—সব কিছুতেই ছায়া ফেলে রেখেছে এই ‘সৃজনশীল’ চুরির সংস্কৃতি। রাষ্ট্র যেন বলতে চায়: “চুরি করো, তবে অভিনবভাবে।”
এক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কেন্দ্র। আজ সেগুলো রূপ নিয়েছে নিয়োগ বাণিজ্যের হাটে। শিক্ষকতার মাপকাঠি এখন আর মেধা নয়—ব্যাংক হিসাব, রাজনৈতিক ব্যানার আর নেতার সাথে ছবি। ছাত্ররা ক্লাস নয়, ব্যস্ত থাকে ব্যানার আর পদ-পদবির পেছনে। ভবিষ্যৎ গড়ে বই নয়, ব্যানারে—এ যেন আজকের পাঠ্যপুস্তক।
বিচারব্যবস্থা? সেটা যেন এক প্রহসনের মঞ্চ। বড় চোর হলে মামলা লাগে না, বরং প্রটোকল পায়। পুলিশ আগে থেকেই সালাম দেয়। কেউ কেউ তো আবার চুরির টাকায় বিদেশ সফরে যায়, পুরস্কারও পায়, আর বলে—“আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে!” এ যেন এক নতুন ধাঁচের উন্নয়ন, যেখানে জনগণের টাকা খরচ হয়, কিন্তু জনগণই জানে না কেন।
ব্যাংক এখন আর সাধারণ মানুষের টাকা রাখার জায়গা নয়, বরং ক্ষমতাবানদের জন্য ‘গোপন লুট তহবিল লিমিটেড’। বড় চুরিতে তদন্ত হয় কাগজে-কলমে, রিপোর্টে লেখা থাকে—“সব কিছু নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে।” যেন সত্য বলাটাই আজ অপরাধ, আর মিথ্যা বলাটাই প্রজ্ঞার পরিচয়।
প্রশাসন, পুলিশ, আদালত—সবখানে যেন অলিখিত একটি কোড চালু আছে: “যদি চোর হও, তবে নিরাপদে আছো।” সৎ মানুষ হলে তার জীবন শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ, হুমকি আর অপমানের মধ্যে দিয়ে। কোনো সাহসী সাংবাদিক যদি সত্য প্রকাশ করে, তার নামে আগে মামলা হয়, পরে পুরস্কার—যদি সে টিকে থাকে।
এখন ভোট মানে কেবল একটা উৎসব, যার ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত। জনগণ জানে, যার প্রচারণায় শোনা যায় “আমি দেশ গড়তে এসেছি”, তিনিই হয়তো আগের রাতেই বিদ্যুৎ বা রেলের কিংবা ভূমির টাকা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতার পকেট ভারী, আর সাধারণ মানুষের পকেট হালকা—এটাই এখন বাস্তবতা। বাজারে গেলে দেখা যায়, চাল-ডাল-পেঁয়াজের চড়া দামে নেই কোনো ঘাটতি, ঘাটতি কেবল সততায়। মূল্যবৃদ্ধির মূলেও আছে চুরি, সিন্ডিকেট আর নীরব লুণ্ঠন।
তারপরও কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ কলম চালায়, মনের ক্ষোভে আঁকে একটি স্বচ্ছ রাষ্ট্রের ছবি। কারণ তারা বিশ্বাস করে, একদিন আসবে এমন এক নেতৃত্ব, যার শৈশবে থাকবে না চুরির গল্প, যার কথায় থাকবে না প্রতারণার ঘ্রাণ। যে বলবে—“আমি জনগণের প্রতিনিধি, ক্ষমতার নয়।”
সেদিন সংসদে বসবে এমন কেউ, যে একদিন সত্যিই জুতা পাহারা দিয়েছিল, কিন্তু কখনও চুরি করেনি। সেদিন রাষ্ট্র গর্ব করে বলবে—“আমি জনগণের হাতে গড়া, লুটেরাদের নয়।”
