কদমের সৌন্দর্য্যে আন্দোলিত চারপাশ

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ।।

বর্ষার আগমন ঘটে প্রকৃতিকে অঝোর ধারায় ভিজানোর প্রত্যয়ে। ষড়ঋতুর দেশে বর্ষা দ্বিতীয় ঋতু। বাদলের ধারা পারিপাশির্^ক সকল পরিবেশকে ম্লান করিয়ে আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে পেখম তুলে ময়ূর নাচে। বর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য। বর্ষা মানেই আবেগের সমাহার, অনুভূতির জোয়ার। এ জোয়ারে সকল কবি সাহিত্যিক ভাসেন মনের আনন্দে। সাধারণ মানুষও ছিটেফোটা কয়েকজন বাদে বর্ষার রূপকে মন দিয়ে অনুভব করে। সকল কবিদের জন্য আষাঢ়ষ্য বৃষ্টি এক বিপুল বিষ্ময় নিয়ে আবির্ভূত হয়।
বৃষ্টি না হলে শস্যাদি জন্মাবে না, বেড়ে উঠবে না প্রাণপ্রকৃতি। বর্ষার জলাভাবে মাটি হয়ে উঠে অনুর্বর আর বর্ষা এসেই আবার উর্বরতা ফিরিয়ে দেয়। আমাদের মাঠ, ঘাট, নদ-নদী, হাওর কুল, সবুজ-শ্যামলে ভরে উঠে। নদী-নালা, খাল-বিল ভরে উঠে পানিতে। নতুন প্রাণের সঞ্চরণ ঘটে। তাই আমরা বলি বর্ষা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। যে নতুন মাত্রা এক পশলা বৃষ্টি নিয়ে আসে প্রাণস্পন্দনে তা আর অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না। বর্ষায় পূর্ণযৌবনা হয়ে উঠে আমাদের নদ-নদীগুলো। ফেঁপে উঠে নদীর পানি জোয়ারের সৃষ্টি করে প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা প্রাচুর্য্য ঘটায় আমাদের শস্যভান্ডারে। শাপলা-শালুক খালে বিলে ফুটে উঠে। কেয়া আর হিজল বিমোহিত করে প্রাণ মনকে।
বৃষ্টি বেশি হলে গরিব মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে এটি একটি ব্যতিক্রম। আর সাধারণের জন্য সামান্য আলস্যে কেটে যায় দিন। কিন্তু সুখের বার্তা হচ্ছে মা বোনেরা ঘরে বসে সে সময় নকশী কাঁথায় ফুল তুলে। কালীদাশ থেকে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, ফারুখ আহমদ থেকে হুমায়ুন আহমেদ কেউই বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। কাজল মেঘের অপরূপ দিকপ্রান্ত, মেঘ-বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, বৃষ্টির রূপালি জল ভুলিয়ে দেয় কবি মানসকে, স্নিগ্ধ অনুভূতি দেয় কাব্যালোকে। আষাঢ়ের আরেক পরিচয় উৎসবের। এ সময় কন্যারা বাপের বাড়িতে নাইয়র আসে। এ মাসে রথযাত্রা হয় মহাউৎসব। এ উপলক্ষে অনেক মেলাও বসে। ধরীত্রিকে সবুজ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ফলদ, বনজ, ঔষধিগাছের চারা বিতরণ করা হয়। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যে বর্ষা প্রেমিকরা দলবেঁধে ঢোল, তবলা বাজিয়ে সংগঠিত করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সুর লহরীতে প্রাণ মাতায় সেতার বিচিত্রা। ভিন্নমাত্রিক বর্ষাকে একসময় বিদায় জানাতে হয় আগামী বর্ষার প্রতীক্ষায়। তাই জাতীয় কবি বর্ষাকে বিদায় জানিয়েছেন-
“ওগো বাদলের পরী
যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী”
বাংলার অর্থনীতি ও কৃষি বর্ষা নির্ভর। উপযুক্ত বৃষ্টিপাত আশানুরূপ ফলনে সহায়তা করে। আর অনাবৃষ্টি ও খরায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই বর্ষাকাল আমাদের জীবনে সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শহরের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনে বর্ষা খানিকটা হলেও প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি, শহরের ধূলাবালিকে বশ করে। তবে বর্ষায় শহরের রাস্তাঘাট অল্পবৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়, যা সর্বসাধারণের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। অতিবর্ষণে সৃষ্ট হয় নদীভাঙ্গন ও বন্যা। সবার উর্ধ্বে বর্ষায় ফোটে কদম ফুল, আরও ফোটে কেতকী। যা বর্ষার রূপকে বাড়িয়ে দেয়। বাদলা দিনে প্রথম কদম ফোটার দিন। বর্ষার আগমণে গাছে শোভাবর্ধন করে কদম ফুল। বাদল দিনে সেই কদম ফুল যেন আবার নূপুরের শব্দ শোনায়। নূপুরের শব্দে জেগে উঠুক আমাদের পরিচ্ছন্নতার আবেশ যা ধরণীকে করবে সঠিক জীববৈচিত্রে ভরপুর।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।