তারুণ্যের জাগরণ, পরিবর্তনের শপথ

মনোয়ার হোসেন রতন।।

প্রতিটি বিপ্লবের সূচনা হয় স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ নিয়ে। ইতিহাস আমাদের তা-ই বলে। একদিন বলশেভিক বিপ্লবের অগ্নিমুখে রচিত হয়েছিল তিনটি শব্দ— “রুটি, জমি ও শান্তি”। ক্ষুধা, দখলদারিত্ব ও যুদ্ধবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনতার এক বিস্ফোরণ ছিল তা। কিউবার তরুণ ফিদেল বলেছিলেন, “সবাই খাবে, কেউ না খেয়ে থাকবে না। বাতিস্তার লুটপাট আর চলবে না।” মানুষ জেগেছিল। জাপানে স্লোগান উঠেছিল— “পড়তে হবে, লিখতে হবে, জানতে হবে, না জানলে জেল হবে।” তারা জানত, অজ্ঞতা মানেই দাসত্ব। আর ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা বলেছিল, “ফরাসিরা না গেলে আমরা মরবো, আমাদের মুক্তি নেই।”
এ সব ইতিহাসের পাশে ২০২৪ সালের বাংলাদেশের তারুণ্যের জাগরণ ছিল এক অনন্য অধ্যায়। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা যখন রাস্তায় নামল, তখন তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, কিন্তু বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। তারা জানত— এ রাষ্ট্রব্যবস্থা কেবল দুর্নীতিবাজদের জন্য। এ গণতন্ত্র, এ ভোটাধিকার, এ আইনের শাসন কেবল কাগজে কলমে। বাস্তবে শাসকেরা গুম করে, হত্যা করে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে অন্য মতের ওপর নিপীড়ন চালায়। তারা বুঝে গিয়েছিল— এ রাষ্ট্রে যদি দুর্নীতিবাজ, খুনি, লুটেরা, ফ্যাসিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বসে থাকে, তবে জনতার মুক্তি নেই। তাই তারা বলেছিল, “যতবারই হত্যা করো, জন্মাবো আবার!”
এ স্লোগান ছিল না কেবল কণ্ঠে, ছিল রাজপথে রক্তের অল্পনায়। সেই রক্তমাখা ৩৬ দিন ছিল এক জাতীয় আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। একদিকে গুলি, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার, গুম; অন্যদিকে গণসংগীত, মিছিল, মানববন্ধন, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, সাহস আর আত্মত্যাগ। এ ছিল আমাদের নতুন যুগের জনযুদ্ধ। সকল অন্যায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
শুধু ছাত্র নয়, গার্মেন্টস শ্রমিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, কৃষকসহ—সবাই অর্থাৎ সকল ছাত্র-জনতা এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতি বোঝে গিয়েছিল, এ আন্দোলন কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নয়—এ এক নতুন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই।
এ আন্দোলন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বিশুদ্ধ জনতার লড়াই, যেখানে সামনে ছিল তরুণেরা— যারা কোনো দলীয় লাঠিয়াল নয়, তারা ছিল সচেতন, সাহসী, স্বপ্নদ্রষ্টা।
আমরা দেখেছি, কত তরুণ শহীদ হয়েছে। আবু সাঈদ, ইয়ামিন, রাফি, মুগ্ধ, রিয়া… আরও অনেক নাম ইতিহাসের পাতায় রক্তে লেখা হয়ে গেছে। তারা ফিরে আসবে না, কিন্তু তাদের আত্মবলিদান আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়—এ দেশ কি এখনো তাদের স্বপ্নের পথে হাঁটছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে, আমাদের নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কি এখনো সেই বৈষম্য, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছি? নাকি পুরনো শাসকদের মুখোশ পড়ে আজকের কিছু মুখ নতুন রং লাগিয়ে একই অন্যায় চালিয়ে যাচ্ছে?
এ প্রজন্ম, যারা রাজপথে রক্ত দিয়েছে, তাদের স্বপ্ন ছিল— একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। তারা প্রতিশোধ চায়নি, চেয়েছে ইতিবাচক সংস্কার। তারা শাসকের পতন চেয়েছে, কিন্তু সমাজ ধ্বংস নয়। তারা লুটপাটের অবসান চেয়েছে, কিন্তু রক্তে নয়—সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে মানবিক ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠায়।
আজ সেই রক্তঝরা দিনগুলোর পরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক নতুন প্রেক্ষাপটে। এ সময়ে প্রয়োজন আত্মার গভীরে ডুবে গিয়ে উপলব্ধি করার—আমরা আসলে কেমন সমাজ চাই? একটি ভালোবাসার সমাজ, যেখানে শিশুদের মুখে হাসি থাকবে, মায়ের কোল থাকবে নিরাপদ, লেখকের কলম থাকবে স্বাধীন, এবং শ্রমিকের ঘাম হবে সম্মানিত।
এ দেশ সেই তরুণদের রক্তে তৈরি। তাই এ দেশ কেবল শাসকদের নয়—এ দেশ আমাদের, আমাদের স্বপ্নের। এখন সময় স্বপ্নকে বাস্তব করার, রক্তের বিপ্লবকে রচনার, বিপ্লবে রূপান্তর করার।