চাঁদাবাজির চাঁদ উঠেছে !

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি শব্দ আজ দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছো তা হলো —‘চাঁদাবাজি’। এটি আর কেবল অপরাধ নয়, একপ্রকার সাংগঠনিক দস্যুতা, যা রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনজীবনের গভীরে শেকড় গেড়ে বসেছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন হাতের মাধ্যমে—আজ দেশের প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজির চাঁদ উঠেছে, এবং এ চাঁদের আলোতে পুড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণি ও উদ্যোক্তারা।
তথ্যই বলছে: ভয়াবহ চিত্র
সম্প্রতি ‘Organized Crime Index 2023’-এ বাংলাদেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্রের সক্রিয় দেশ হিসেবে। এতে বলা হয়, গ্যাং, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট সংগঠন ও স্থানীয় মাস্তান চক্রদের মাধ্যমে সারাদেশে ‘চাঁদা সংগ্রহ ব্যবস্থা’ এখন এককথায় ‘institutionalized extortion’-এ পরিণত হয়েছে। এমনকি শ্রমজীবী মানুষ, পরিবহন, নির্মাণ, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্যসেবাতেও চাঁদাবাজদের করাল ছায়া পড়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (DCCI) ২০২৫ সালের একটি আলোচনায় জানায়—বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এখন আইনের চেয়ে চাঁদাবাজদের বেশি ভয় পান। কারণ, পুলিশ ও প্রশাসন অনেক সময় ‘অদৃশ্য চাপে’ নিষ্ক্রিয় থাকে, কিংবা ‘সমঝোতা’র পরামর্শ দেয়। ফলে আইনি আশ্রয়ের বদলে ব্যবসায়ীরা ‘চাঁদা দিয়ে বাঁচি’ মানসিকতায় চলতে বাধ্য হন।
সাম্প্রতিক ঘটনা: কেবল একটি দৃষ্টান্ত নয়
২০২৫ সালের জুলাইয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা চাঁদাবাজির ভয়াবহতার নির্মম দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। এ ঘটনায় একটি রাজনৈতিক দল পাঁচ কর্মীকে বহিষ্কার করলেও মূল প্রশ্ন থেকে যায়—চাঁদাবাজির এ সংস্কৃতির জন্ম কে দিল? কেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এরা এতটা প্রভাবশালী?
চাঁদাবাজির রূপ ও প্রভাব
১. পেশিশক্তিনির্ভর চাঁদাবাজি
যানবাহন চলাচল, বাজার নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ প্রকল্প, এমনকি স্কুল-কলেজের গেইটেও ‘চাঁদার লোক’ ঘুরে বেড়ায়। একবার চাঁদা দিলেই তাদের রেকর্ডে উঠে যায় নাম—পরবর্তীতে মাসিক, এমনকি উৎসব ভিত্তিতেও চাঁদা আদায় হয়।
২. রাজনৈতিক মাস্তানতন্ত্র
অনেক রাজনৈতিক দলের নামে গঠিত স্থানীয় ক্লাব, ফোরাম, যুব বা ছাত্রসংগঠন চাঁদাবাজিতে যুক্ত। ভোট এলেই তারা হয় ব্যানার-বিলবোর্ডের নামে, না হয় সভা-সমাবেশের অজুহাতে অর্থ আদায় শুরু করে।
৩. সামাজিক আতঙ্ক
অফিস খোলা, দোকান তোলা, নতুন ঘর নির্মাণ—যেকোন উদ্যোগেই আগে আসে “কত দিবেন?” প্রশ্ন। না দিলে হুমকি-ধমকি বা হামলা—চাঁদা না দিলে বেঁচে থাকা অসম্ভব!
৪. প্রশাসনিক নীরবতা
অনেক সময় চাঁদাবাজদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও যোগাযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগ করলেই বলা হয়, ‘আপনার নিরাপত্তার কথা ভেবে বলছি, একটু বুঝে চলুন’—এই বুঝে চলাই আজকের ভয়াবহ বাস্তবতা।
ভুক্তভোগীদের স্বর
একজন ট্রাক চালক বলেন,
“এক পয়েন্টে মাল নামাতে গেলে ৫০০ টাকা, উঠাতে গেলে আরেকজনকে দিতে হয় ৩০০ টাকা। এরপর পুলিশের জন্য ‘চা-পানি’। সব শেষে বাড়ি যাই ৫০ টাকা হাতে নিয়ে।”
একজন তরুণ উদ্যোক্তা জানালেন,
“দোকান খোলার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি আলাদা সংগঠন চাঁদা নিতে আসে। না দিলে বলে—এই এলাকায় ব্যবসা করাটা সহজ নয় ভাই!”
মুক্তির পথ: করণীয় কী?
আইন প্রয়োগে কঠোরতা:
চাঁদাবাজির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি। যারা সংগঠিতভাবে চাঁদা আদায় করে, তাদের সম্পদ জব্দ ও সামাজিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার। এসব চাঁদাবাজদের সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে বয়কট করার সময় এখনই।
রাজনৈতিক সাহসিকতা:
দলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ না হলে এ অভিশাপ বন্ধ হবে না। প্রয়োজন রাজনৈতিক আত্মশুদ্ধি এবং চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।
ব্যবসায়ী-নাগরিক ঐক্য:
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে চাঁদাবাজি বিরোধী অবস্থানে সক্রিয় হতে হবে। সাধারণ মানুষকে ভয় কাটিয়ে মুখ খুলতে হবে, না হলে এ অন্ধকার দিন দিন আরো ঘনীভূত হবে।
মিডিয়ার নির্ভীক ভূমিকা:
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের নির্ভীক রিপোর্টিংয়ে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, চাঁদাবাজদের মুখোশ উন্মোচনের শক্তিশালী অস্ত্র—সত্যনিষ্ঠ সংবাদ।
বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে—অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন মানুষ জেগে উঠেছে, তখনই পরিবর্তন এসেছে। আজ এ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার সময়। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের বলতে হবে—‘না, আর না!’
এ চাঁদাবাজির চাঁদ যদি আজই নিভানো না যায়, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাবো এক চাঁদার রাষ্ট্র, ভয়ের সমাজ এবং ন্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
তাই আজই সময়—আসুন, আমরা সবাই মিলে বলি:
“চাঁদা নয়, ন্যায্য অধিকার চাই।”
“ভয় নয়, প্রতিবাদেই মুক্তি।”
তথ্যসূত্র:
১. Organized Crime Index 2023 – https://ocindex.net/…
২. TBS News Report, May 2025 – https://www.tbsnews.net/
৩. ThePrint – https://theprint.in/world/
৪. University of Manchester Report – https://research.manchester.
