বর্ষা বিপ্লব: রক্তে লিখেছি এই ইতিহাস


।।মনোয়ার হোসেন রতন ।।
“আমি রক্তে লিখেছি, আমি চোখের জলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভিজিয়েছি। আমি প্রেম করিনি—আমি দেশকে ভালোবেসেছি আগুনের মতো। আমি কলম ধরিনি কেবল লেখার জন্য,
আমি কলম ধরেছিলাম—জেগে ওঠার জন্য।”
২০২৪ সালের বর্ষা, সেই জুলাই-আগস্টের ভেজা দুপুরে আমি ছিলাম রাজপথে—শুধু আমিই নই, হাজারো ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-জনতা, যারা কাঁধে ব্যাগ আর হাতে হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল—অন্ধকারের বিপরীতে, রক্তলোলুপ শাসকের মুখোমুখি।
তারা কেউ কবি ছিল না, তবু তাদের শ্লোগান ছিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পঙক্তি—
“এই রাষ্ট্র আমার, এই পথ আমার, শহীদের রক্তের ঋণ আমার!” “গুমের জবাব চাই, নিখোঁজের সন্ধান চাই!”
“তুমি না ফিরলে, আমরা থামবো না!”
আমি নিজ চোখে দেখেছি—রফিক আদনান কেমন বুক পেতে দিয়েছিল লাঠির মুখে, সুমাইয়া পারভীন কেমন স্লোগান দিতে দিতে পড়ে গিয়েছিল পুলিশের বুটের নিচে, তারিক ইমরান কীভাবে ‘স্বাধীনতার চেতনা’ বলতে বলতে নিখোঁজ হয়ে গেলো সেই রাতেই। আর যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কথা তো আমরা জানি। আর যারা এখনো রাজপথে আছেন, সেই সব বীর যোদ্ধাদের এখনো তো আমরা দেখছি।
তারা হাসছিল না, তারা কাঁদছিল না—
তাদের চোখে ছিল কেবল একরাশ প্রত্যয়:
“আমরা আজ মরে যাবো, কিন্তু কাল বাঁচবে দেশ!”
সেই রাজপথ রক্তে লাল হয়েছিল—বৃষ্টি-ভেজা দিনে মিশে গিয়েছিল শহীদের রক্ত আর আকাশের অশ্রু।
আমি বলি, বন্ধু—এই বিপ্লব প্রেমের কাব্য নয়, এটি ছিল রক্তে লেখা এক মহাকাব্য,
যেখানে প্রতিটি শব্দ ছিল ক্ষোভ, প্রতিটি নিঃশ্বাস ছিল লড়াই। আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে লিখছি—আর আমার কানে বাজে সেইসব কণ্ঠ—
“মা, আজ যদি ফিরতে না পারি—আমার নামে একটি বৃক্ষ লাগিও।” “ভবিষ্যতের শিশুরা যেন দাস না হয়, তাই আজ আমি পথে।”
বন্ধু, আজ তুমি যদি সোফায় বসে ভাবো বিপ্লব শেষ, তবে শোনো—আমার পিঠে এখনো দাগ, আমার চুলে আজও গন্ধ সেই গ্যাসের, আর আমার স্মৃতিতে আজও বাজে সেই গুলির শব্দ।
আমি জানি, অনেকেই এখন উপদেষ্টা হয়েছেন—তারা পরিশ্রুত, সংযত, কূটনৈতিক। তাদের মুখে শ্লোগান নেই, হাতে ব্যানার নেই—তবে তাদের হৃদয়ে আজও সেই বর্ষা বাজে, আর তারাও চেষ্টা করে চলেছেন পরিবর্তনের অন্যপথে।
কিন্তু আমরা যারা এখনও রাজপথে,
যারা এখনও হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস, নাহিদ, জারাদের রক্তে জাগ্রত, তারা জানে—এই বিপ্লব থামেনি, শুধু রূপ বদলেছে।
“তুমি আমাকে জবাই করতে পারো, কিন্তু আমার স্লোগানকে গলাটিপে মারতে পারো না।
কারণ আমি মানুষ—আর মানুষ একবার জেগে উঠলে, তাকে কোনো শাসক আর নিঃশেষ করতে পারে না।”
তাই বলি—বর্ষা বিপ্লব ছিল প্রেমের কবিতা নয়, এটি ছিল সেই প্রেম—যে প্রেম রক্তে লিখে যায় স্বপ্ন, যে প্রেম অস্ত্র না হয়ে আলো হয়ে জ্বলে ওঠে বাতিঘরের মতন।
বন্ধু, তুমি যদি কখনো ওই শহীদদের নামে একটি কবিতা লেখো, তবে শুধু তাদের নাম নয়, তাদের চোখের ভাষা, তাদের বুকের স্পর্ধা, তাদের কণ্ঠের আগুন দিয়েই লেখো। কারণ এই ইতিহাস কেবল তথ্য নয়—এই ইতিহাস মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বলা ‘না’-এর গল্প। এটি সাহিত্যের নয়, এটি রক্তের ঋণ পরিশোধের প্রথম অধ্যায়।
“তুমি যদি ভুলে যাও, আমি মনে রাখবো।আমি যদি ভুলে যাই, এই মাটি মনে রাখবে।এই বিপ্লব কারও নয়—এই বিপ্লব বাংলার বুকে জন্ম নেয়া, প্রতিটি সত্যপ্রেমিক মানুষের চেতনা।”
— বর্ষা বিপ্লবের একজন সৈনিক, একজন লেখক, একজন প্রেমিক।