রাজনীতিতে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার 

 

মনোয়ার হোসেন রতন।।

মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই রাজনীতি মানুষের নৈতিকতা, আচরণ ও নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু আজকের রাজনীতিতে যখন আমরা অশ্লীলতা, গালাগালি, প্রতিহিংসা ও চরিত্রহননের দৃষ্টান্ত দেখি, তখন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে—এক সময় রাজনীতি ছিল ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও আদর্শিক সৌজন্যের মন্দির। বিশেষত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন বহু নেতা ছিলেন, যাঁদের ব্যক্তিত্ব ছিল আকাশসম, কিন্তু আচরণে ছিলেন বিনয়ের দৃষ্টান্ত।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক : প্রতিপক্ষকেও সম্মান

উনিশ শতকের শেষভাগে জন্ম নেওয়া শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩–১৯৬২) ছিলেন মুসলিম রাজনীতির এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হিন্দু নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন—আর তা কেবল রাজনৈতিক নয়, নৈতিক উচ্চতারও দৃষ্টান্ত। তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যে প্রতিপক্ষের নীতিকে সমালোচনা করলেও, ব্যক্তিগতভাবে তাদের সম্মান করতেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন একবার মন্তব্য করেছিলেন—“ফজলুল হকের মতো রাজনৈতিক সৌজন্যসম্পন্ন নেতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও বিরল।”

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : রাজনীতির আদালতে যুক্তি ও ব্যঙ্গ

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২–১৯৬৩) ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজনৈতিক ভাষা ছিল যুক্তিসম্মত, ব্যঙ্গ-রসাত্মক, কিন্তু কখনোই কুরুচিপূর্ণ নয়। একবার এক রাজনৈতিক বিতর্কে বিরোধী নেতা তাঁকে “উগ্র” বললে তিনি হেসে বলেছিলেন—“উগ্রতা নয়, আমি জনগণের দাবির অনুবাদক মাত্র!” এই উত্তরে স্পষ্ট হয়—তিনি আক্রমণ নয়, উত্তরণের রাজনীতি করতেন।

মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী : বিরোধিতার মধ্যেও ভ্রাতৃত্ব

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০–১৯৭৬) “লাল সালাম” বলেই সমবেত জনতার হৃদয় জয় করতেন। তিনি ছিলেন কঠোর প্রতিবাদী, কিন্তু অপমানকারী নন। তাঁর কণ্ঠে ছিল প্রতিবাদ, কিন্তু ভাষায় ছিল মানবতা। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধিতা করলেও, তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি বলেছিলেন—“বঙ্গবন্ধু এই বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর বিদায় আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।” এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও সম্মান জানানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

মহাত্মা গান্ধী : অহিংস রাজনীতির প্রতিমূর্তি

ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯–১৯৪৮) অহিংসার দর্শনকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানিয়েছিলেন। তাঁর ভাষা ছিল শান্তিপূর্ণ, নির্লিপ্ত, এবং কটুক্তিহীন। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি। একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—“আপনি কি ব্রিটিশদের ঘৃণা করেন?” তিনি বলেছিলেন—“আমি ঘৃণা করি অন্যায়কে, অন্যায়কারীকেও নয়।”

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ : শৃঙ্খলার প্রতীক

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬–১৯৪৮) ছিলেন আইনজ্ঞ ও শৃঙ্খলার প্রতিমূর্তি। তাঁর বক্তৃতা ছিল যুক্তি ও গঠনমূলক সমালোচনায় পরিপূর্ণ, কিন্তু ঘৃণামুক্ত। পাকিস্তানের দাবি তোলার সময়ও তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সচেতন ছিলেন। তাঁর ভাষণে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল না—ছিল রাজনৈতিক দাবির যুক্তিনির্ভর প্রকাশ।

আধুনিক বিশ্বের কিছু উদাহরণ

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেলসন ম্যান্ডেলা (দক্ষিণ আফ্রিকা), জন এফ কেনেডি (যুক্তরাষ্ট্র) কিংবা অ্যাঞ্জেলা মার্কেল (জার্মানি)—তাঁরা সবাই প্রতিপক্ষের প্রতি ন্যূনতম সম্মান বজায় রেখে মতপ্রকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। ম্যান্ডেলা, যিনি দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবরণ করেন, ক্ষমতায় এসে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেননি—বরং আলোচনার মাধ্যমে “জাতীয় পুনর্মিলন” আনেন।

বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া রাজনীতি

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এক দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে কিছু সৌজন্যবোধ টিকে ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাজনীতি হয়ে উঠেছে বিদ্বেষপূর্ণ, প্রতিহিংসামূলক ও অশালীন। সংসদীয় ভাষা কাদা ছোড়াছুড়ির, সামাজিক মাধ্যম নেতাদের ভাষা ব্যক্তিগত আক্রমণের, আর বক্তৃতা যেন গালিগালাজের প্রতিযোগিতা। কেউ কাউকে সম্মান করে না—শুধু ক্ষমতার লোভে অপমান করে। ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতিকে মনে করে বিষাক্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে আদর্শ নেই, কেবল বিদ্বেষ।

ফিরে আসুক ভদ্রতার রাজনীতি

রাজনীতি যদি জাতির চালিকা শক্তি হয়, তাহলে তার ভাষা হওয়া উচিত গণমানুষের আশা ও মানবতার কণ্ঠস্বর। আমাদের দরকার সেই রাজনীতি, যেখানে মতভেদ থাকবে কিন্তু মনভেদ থাকবে না; বিরোধিতা থাকবে, কিন্তু শালীনতা অটুট থাকবে।
সময় এসেছে রাজনীতিকে আবার ভদ্রলোকের অঙ্গন বানানোর—যেখানে বক্তৃতা হবে যুক্তিনির্ভর, আচরণ হবে শালীন, আর প্রতিপক্ষ হবে প্রতিপক্ষ, শত্রু নয়।

রাজনীতির ভাষা যদি নোংরা হয়, তাহলে রাজনীতি হবে আগুনে পুড়ে যাওয়া এক গণতন্ত্রের কঙ্কাল। অতএব, ফিরে যাই ফজলুল হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর কাছে—যাঁরা শিখিয়েছেন, নেতৃত্ব মানেই গর্জন নয়, বরং গঠন।

inside post
আরো পড়ুন