মোগলটুলীর যত গুণীজন

 

inside post

।। আবদুল আজিজ মাসুদ ।।
বলা হয় শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপিঠ কুমিল্লা,আর কুমিল্লার শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টি কালচারকে উজ্জীবিত রাখতে মোগলটুলীর অবদান কম নয়। সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা বিশেষ করে কুমিল্লার নাট্যাঙ্গন, ষাট সত্তুরের দশকে মোগলটুলীবাসীর পদচারণায় মুখরিত থাকতো। নাট্যজন শাহজাহান চৌধুরী তাঁর ‘ কুমিল্লার নাট্যাঙ্গন ও আমি ‘গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন,’বলতে গেলে মোগলটুলী এলাকাটি স্বাধীনতার পূর্বে যেমন,স্বাধীনতার উত্তর কুমিল্লার নাট্যাঙ্গনকেও পথ দেখিয়েছে।’ সে সময়কার গড়ে উঠা মোগলটুলী কেন্দ্রীক নাট্য সংগঠন গুলোই কুমিল্লার নাট্যাঙ্গনকে উজ্জীবিত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, কুমিল্লাবাসীকে উপহার দিয়েছে অসংখ্য মঞ্চ সফল নাটক।
কে এম নিজাম
ষাটের দশকের শুরুতে নাট্যকার কে এম নিজাম প্রতিষ্ঠা করেন এ্যাপোলো নাট্যসংসদ। তিনি প্রায় দশটি নাটকরচনা করেন।এ গুলোর মধ্যে: মা নেই ঘরে (১৯৬০),ছোট্ট একটি নীড়,শেষ নয় শুরু,(১৯৮০)অনাথ(১৯৯৬),রক্তে রাঙ্গানো বাংলাদেশ,(১৯৮৫),প্রিিতবাদ(১৯৭৭),রক্ত হলো মেহেদী, মাতৃভূমির ডাক,প্রতিমা বিসর্জন (১৯৯৫,),স্মৃতির বাঁধন(১৯৬৭),বেদনার তৃপ্তি(১৯৬৫)মিথ্যে আশা(১৯৫৯)
কুমিল্লা টাউন হল নাট্য মঞ্চে স্বাধীনতা উত্তর কালে তাঁর রচিত মুক্তি যুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘ মাতৃভূমির ডাক (১৯৭২)’ সফল প্রযোজনা। কে এম নিজাম শুধু নাটক রচনাই করতেন না মঞ্চ নেপথ্যে শিল্পীদের রূপ সজ্জা, মঞ্চ সজ্জায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর ছেলে কে এম নাজিম এ্যাপোলোর হাল ধরেছেন। তিনিও অভিনয়, নাট্য নির্দেশনায় পরিপক্ব হচ্ছেন।
‘মোগলটুলী কৃষ্টি সংসদ’
স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সৈয়দ আবদুল্লাহ পিন্টু ও এম ডি মুরাদ গঠন করেন মোগটুলী কৃষ্টি সংসদ, জানা যায় লেখক এম ডি মুরাদ প্রায় অর্ধশতাধিক নাটক উপন্যাস রচনা করেন। স্বাধীনতা উত্তর এম ডি মুরাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মঞ্চ সফল নাটক’ বিপ্লবী বাংলা ‘ মঞ্চস্ত হয় ২০,২১ জুন ১৯৭২ সালে। এ নাটকটি কুমিল্লার মঞ্চে প্রথম স্বাধীনতা ভিত্তিক নাটক। এ নাটকে মোগলটুলীর কে এম নিজাম, আফজাল, কে এম আলমগীর, আশরাফ উদ্দিন রহমত,অভিনয় করেন। লেখক এম ডি মুরাদ স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন প্রকাশকের নিকট গ্রন্থের স্বত্ব বিক্রি করে দিতেন। ১৯৯৭সনে ২১’ র বই মেলা উপলক্ষে সাহিত্য একাডেমি ও জুয়েল ব্রদার্স তাঁর ৪টি উপন্যাস বের করে। উপন্যাস গুলো হলো ‘প্রেম দেব কি দেব না’ ‘,তোমার রক্তে আমার সোহাগ’, ‘কতো দিন দেখিনি তোমায়’,’ভালো বাসি ভালো বাসবো’। প্রকাশক সূত্রে জানা যায় মফস্বলের পাঠকের নিকট তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত পুস্তকের তালিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

ষাট সত্তরের দশকে শহর কুমিল্লা যেন নাটক,সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়ার নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছিল সাহিত্য,সংস্কৃতি, ক্রীড়া সংগঠন। চর্চা হতো নিয়মিত। তরুণদের ব্যস্ততা ছিল গল্প,কবিতা নাট্য চর্চা আর খেলাধুলায়। সেই সময়ের তরুণদের সৃষ্টি ‘ আটু বাটুল’ ‘সে আমি তুমি’ ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী’ ‘ ছিপ ফেলে বসে আছি’ অশ্রু হলো বারুদ,চাবি খুঁজছি মহারাজ,এমনি আরো চমকপ্রদ বাহারি নামের সাহিত্যপত্র, সাহিত্য সংগঠন। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বের হতো দেয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য ম্যাগাজিন,ইত্যাদি। সুকুমার বৃত্তির এই চর্চায় সময় কাটতো তরুণদের। সর্বনাশা নেশার ইন্দ্র জালে জড়ানোর সুযোগ কমই ছিল। সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার এই ঢেউ মোগলটুলীর তরুণ সমাজকেও উজ্জীবিত করে।
তখন গোমতী ক্লাব থেকে বের হয় লিটল ম্যাগাজিন ‘ফুটে আছি যুদ্ধে’ নামকরণ এবং প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন প্রয়াত কবি বাবুল ইসলাম। হাজী তারু মিয়া ব্যাডমিনটন টুর্নামেন্ট ‘৯১ উপলক্ষে স্যুভেনিয়র।আবুল কালাম আজাদ( পরে ড,আবুল আজাদ ) এর সাথে বের করি লিটল ম্যাগাজিন’ শতদল ‘সেই সোনালী সময়ে মোগলটুলীর নাটক পাগল তরুণরা যে কয়েকটি নাট্য সংগঠন গঠন করেছিল সে গুলোর মধ্যে :
মোগলটুলী একতা সংঘ
১৯৭২সালে গঠিত হয় ‘মোগলটুলী একতা সংঘ, সভাপতি সৈয়দ জামাল হোসেন, সম্পাদক কে এম আলমগীর। তাদের সূচনা প্রযোজনা ছিল কে এম নিজামের স্বাধীনতা ভিত্তিক নাটক ‘ মাতৃভূমির ডাক’।

উদয়ন কৃষ্টি সংসদ
১৯৭৩সালে নাট্যকার মাকসুদুর রহমান মিন্টু (১৯৪৬-২০০১) গঠন করেন ‘ উদয়ন কৃষ্টি সংসদ ‘ তিনি মঞ্চায়ন করেন তার লেখা নাটক’ অগ্নি দাহ’ ‘ ওরা আমাদের সন্তান ‘ সহ বেশ ক’ টি নাটক। তাঁর রচিত উনসত্তর’র গণ আন্দোলনের উপর রচিত ‘ মুক্তি নেই ‘ বীর চন্দ্র নগর মিলনায়তন মঞ্চে মঞ্চায়ন করতে গিয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন।
তাঁর ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান, বোন লিলি কুমিল্লার মঞ্চে দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন। তাঁর ছেলে জুলিয়াস মাকসুদ জ্যেতি নাট্যাঙ্গনের সাথে সক্রিয়।
প্রতিধ্বনি নাট্য গোষ্ঠী
১৯৭৫ সালে নাট্যকার সন্মিলন রায় ও কে এম আফজাল গঠন করেন ‘ প্রতিধ্বনি নাট্যগোষ্ঠী’। তারা অধিকাংশ নিজস্ব নাট্যকারের নাটক মঞ্চায়ন করতেন। তারা লেখক এম ডি মুরাদের ছোট ভাই অভিনয় শিল্পী নেছার আহমেদের লেখা ‘ শিল্পী কেন বঞ্চিত ‘ মাকসুদুর রহমান মিন্টুর ‘ অগ্নি দাহ’, সন্মিলন রায়ের’ বাঁশের সাকো ‘, ‘ এক মুঠো ভাত’ ‘ এক জোড়া চাবি’ সহ বহু নাটক মঞ্চায়ন করে।
শুধু অভিনয়, নাটক রচনা ছাড়াও মঞ্চসজ্জা,মেকাপ,লাইটিং, মোগলটুলীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল। জানা যায় কুমিল্লার মঞ্চে আধুনিক লাইটিং’র সূচনা করেন কে এম আলমগীর। মঞ্চে রঙ্গিন নাটকের ক্যারিশমা দেখিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত নাট্য অভিনেতা নাট্য নির্দেশক নিজাম উদ্দিন দুলাল। তিনি জনতা ব্যাংকের বাৎসরিক নাটক গুলো পরিচালনা করতেন। জনতা ব্যাংকের এক নাটকে মঞ্চে জীবন্ত ঘোড়া এনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি দক্ষ অভিনেতাও ছিলেন।
মোগলটুলীর আরো একজন নাট্যার ছিলেন আব্বাসউদ্দীন, তিনি এখন অনেকটা স্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন। তাঁর রচিত স্বাধীনতা ভিত্তিক একটি নাটক ” অস্তমিত সূর্য” কুমিল্লা টাউন হল মঞ্চে বহুবার মঞ্চস্হ হয়েছে বলে জানা যায়। তাঁর ছোট ভাই ইউনুসও একজন মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন। তারা দু’ জনেই এখন প্রয়াত। মঞ্চ নেপথ্যে ও মঞ্চে সক্রিয় ছিলেন আকবর আবাদ,ফেমাস টেইলারের শফিকুল ইসলাম দুলাল, সাংবাদিক ওমর ফারুকী তাপস,মোস্তফা আহমেদ,রুহুল আমিন টুনু, আরও অনেকে যাদের নাম সংগ্রহ করতে পারিনি।
-৩
বাংলা রহস্য সাহিত্যের পথিকৃৎ খোন্দকার রেয়ায্ উদ্দিন আহমদ
কুমিল্লার সাহিত্যাঙ্গনের আরও একটি নাম মোগলটুলীর খোন্দকার রেয়ায্ উদ্দিন আহমদ। তাঁর সাহিত্য কর্ম কুমিল্লার সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনকে উজ্জীবিত রাখতে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না।তাঁর রচিত সামাজিক উপন্যাস, সংগ্রামী উপন্যাস, বিজ্ঞান ভিত্তিক গ্রন্থ,রম্য রচনা, জীবনীগ্রন্থ, ছোটদের গল্প উপন্যাস, কিশোর ডিটেকটিভ সিরিজ, দস্যু রানী সিরিজ, রানা সিরিজ, ছায়া মানব সিরিজ সব মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা আশির অধিক।
বাংলা রহস্য সাহিত্য তথা থ্রিলারের জনক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনকে বলা হয়।তিনি ১৯৬৬ সালে মাসুদ রানা সিরিজ বের করে পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে রহস্য পত্রিকা পুস্তকারে প্রকাশ করেন। কিন্তু অনেকই হয়তো জানেন না খোন্দকার রেয়াজ উদ্দিন ১৯৫৮ সালের ১৫ জুন প্রথম মোগলটুলির নাজিরিয়া প্রেস থেকে পাক্ষিক রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা ” ডিটেকটিভ ” বের করেন। নিউজ প্রিন্ট কাগজের ১/১৬ ডাবল ডিমাই সাইজের পৌঁনে দুই ফরমার এই পত্রিকাটির প্রতি প্রতিসংখ্যার মূল্য ছিল চার আনা। বার্ষিক সডাক মূল্য ছিল সাড়ে ছ‘টাকা এবং রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ছিল ডি এ ৩৫৮/পরে মোগলটুলীর ওরিয়েন্টাল প্রেস থেকে বের হতো। চলে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। পাক্ষিক ” ডিটেকটিভ ” কার্যালয়টি এখনো মোগলটুলীতে বিদ্যমান। তাঁর একমাত্র ছেলে হেলাল,হেলাল ডেকোরেটরের অফিস হিসেবে ব্যাবহার করছেন। এ অফিস থেকেই ১৯৫৪ সালে সাহিত্য পত্রিকা ‘ দিগন্ত ‘ বের করতেন খোন্দকার রেয়ায্ উদ্দিন। তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম ভিত্তিক উপন্যাস ‘ রক্তে রাঙা রাজপথ ‘ ও ভাষা আন্দোলনের উপর উপন্যাস ‘ এর শেষ নেই’ তৎকালীন সময়ে কুমিল্লায় বেশ সাড়া জাগিয়ে ছিল বলে জানা যায়।

তাঁর সামাজিক উপন্যাস গুলোর মধ্যে রয়েছে, ভলোবাসায় সুখ,ভালো বাসায় দুঃখ,সুখে দুঃখে প্রেম,ভালো বাসাই জীবন,গরীবের জীবন,রাতের স্বপ্ন, পথে হলো দেখা, এখনি উঠিবে চাঁদ, রিমঝিম বর্ষা, নতুন বউ,ব্যর্থ নায়িকা,তুমি বিনা এ ফাগুন, নারীর মন,এ কালের নায়িকা, নতুন সুরে ডাকো,মেয়েদের প্রেম,প্রিয় বান্ধবী, ভালোবাসি বলে, পাশের বাড়ির মেয়ে, প্রেম হলো অভিশাপ, অচেনা বান্ধবী,এরই নাম প্রেম,ইত্যাদি।
খোন্দকার রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ১৯২৮ সনের ২২ ফেব্রুয়ারি মোগলটুলীতে জন্ম গ্রহণ করেন।
দেড় বৎসর বয়সে মা সুফিয়া খাতুন কে এবং আট বছর বয়সে পিতা তাজুল ইসলাম খোন্দকারকে হারান। শৈশবে পিতৃ মাতৃহীন খোন্দকার রেয়াজ উদ্দিনের নানা আবদুল গণি, নানি আঞ্জুমান নেছার আদর স্নেহে বড় হন। ১৯৪৮ সনে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এক বৎসর অধ্যয়ন করেন। ১৯৮৩ সনে উষসী সাহিত্য পরিষদ তাকে উষসী সাহিত্য পদকে ভূষিত করে।তিনি ২৭ আগস্ট ১৯৯৪ সনে মৃত্যু বরণ করেন। প্রয়াত এই গুণী লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে দুস্প্রাপ্য।-

যাট,সত্তরের দশকে এমন একটা সময় ছিল যখন মোগলটুলীর প্রায় প্রতি ঘরেরই কেউ না কেউ নাটক,ক্রীড়া, সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় জড়িয়ে ছিল। গোমতী ক্লাবসহ মহল্লার বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করতো মঞ্চ নাটক, গানের আসর, মোগলটুলীর চৌমুহনীর ত্রিকোণাকার পার্কে( বর্তমানে ফোয়ারা) রাতে বিশেষ করে শীতের রাতে বসতো কওয়ালি গানের আসর,ওয়াজ মাহফিলও হতো। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে বনাজীঔষধ,তাবিজ কবজ বিক্রেতারা আয়োজন করতো দোতারা গান, পুথি পাঠ,জাদু সার্কাস প্রদর্শনী,রাজনৈতিক পথ সভাও হতো এখানে। বৃটিশ আমলের শেষ দিকে মোগলটুলীর চৌমুহনীতে “সাহানা টকিজ” নামে একটি সিনেমা হল ছিল । পরে সিনেমা হলটি বন্ধ হলে কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান হাজি মোহাম্মদ তারু মিয়া নিজ পুত্রের নামে” কামাল বোর্ডিং “চালু করেন, বর্তমানে এখানে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। থানা রোড গাংচরের কাঠপট্টিতে নাট্য মঞ্চ ছিল যাতে বিভিন্ন সংগঠনের বাৎসরিক নাটক হতো বলে জানা যায়, হাইস্কুলে বাৎসরিক নাটক, বিচিত্রা অনুষ্ঠান হতো।
প্রাচীন এই জনপদে রয়েছে সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক মোগল স্থাপনা’ শাহ সুজা মসজিদ ‘এই মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম হাফেজ ক্বারী সগির মোহাম্মদ যিনি উর্দু কাব্যের রচয়িতা ছিলেন, তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে” রিসালাই তানে তাজজীদ” নামে এক খানি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি কুমিল্লা নিবাসী নওয়াব সৈয়দ হুসামুদ্দিন হায়দার চৌধুরীর(১৮৬৮-১৯২১) নামে এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন।( সূত্র :কুমিল্লা জেলা গেজেটিয়ার পৃষ্ঠা ২১৪)
স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়,লেখক এম ডি মুরাদের সম্পর্কীয় প্রপিতা মদন মিঞা, মৃত্যু ১৯৬৮ ইং( যার নামে মদন পট্টি) পেশায় একজন সাইন বোর্ড লেখক হলেও প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। জানা যায় তিনি দোতারা ও বাঁশি বাজাতেন। সংগীতের বরপুত্র কুমিল্লার কৃতি সন্তান কুমার শচীন দেব বর্মনের সাথে ও কিছু দিন বাঁশি বাজিয়েছেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মোগলটুলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (১৯৫৫-৬৬) এস এ ফাত্তাও যন্ত্র শিল্পী ছিলেন। তিনি পিয়ানো, বাঁশি বাজাতেন। জানা যায় তিনিও শচীন দেব বর্মনের সাথে যন্ত্র সংগত করেছেন।
সুজিত গুহ চান নাট্য নির্দেশনায় ছিল সিদ্ধ হস্ত। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা , নির্দেশক, চিত্র শিল্পী উত্তম গুহ, তারা দুজনেই মোগলটুলীর কৃতি সন্তান।

মুক্তিযুদ্ধ, ক্রীড়া,সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ, ক্রীড়া,সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে মোগলটুলী সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার আহমেদ, বীরমুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামও তাঁর অপর দুই ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম মিন্টু,ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান ফরিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ঝিল্লুর রহমান,বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল্লাহ পিন্টু, বীরমুক্তিযোদ্ধা নাঈমুল হক ভূঁইয়া, বীরমুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম, বীরমুক্তিযোদ্ধা কাজী দৌলত আহমেদ, বীরমুক্তিযোদ্ধা আবু, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ আহমেদ,বীরমুক্তিযোদ্ধাএনামুল হক,বীরমুক্তিযোদ্ধা আলী নূর, বীরমুক্তিযোদ্ধা নজির আহমেদ,বীরমুক্তিযোদ্ধা যতিন চন্দ্র রায়,শহীদ গফুর মিঞা,শহীদ এম এ বারী( মিন্টু মামা),প্রমুখ।
সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতায় দেশের প্রচীনতম আঞ্চলিক সাপ্তাহিক” আমোদ” সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী মোগলটুলীর কৃতি সন্তান। ফজলে রাব্বী ১৯৫৫ ইংরেজি সনে পুরাতন চৌধুরী পাড়া থেকে ‘আমোদ’ র যাত্রা শুরু করেন। সে থেকে আজ অবদি ‘আমোদ’ নিয়মিত বের হচ্ছে। সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ দক্ষিণ এশিয়ার সফল আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি লাভ করে। রাব্বী সাহেব নিজেও একজন স্টাইলিশ ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি বেশ ক’ টি গ্রন্থের প্রণেতা।তাঁর সহধর্মিণী শামসুন্নাহার রাব্বীও আমোদ সম্পাদনা করেছেন এবং একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমেরিকা প্রবাসী নজরুল ইসলাম বাবুল মোগলটুলীর কৃতি সন্তান।
ক্রীড়া
খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদদের মধ্যে, ফুটবলে:শিবলী নোমানী,নান্নু,সুভাষ নন্দী নীলু,শীবু,রুহুল আমিন টুনু,মাস্তান, সার্জেন্ট লিলু,সাবেক কমিশনার আবদুল মতিন,
ব্যাডমিন্টনে: আবদুল হান্নান চৌধুরী মিঠু, বাংলাদেশ ব্যাডমিনটন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবিরুল ইসলাম শিকদার, ক্রীড়া সংগঠক আবদুর রৌফ( মোগলটুলী কমার্স ক্লাব) মো: ইলিয়াছ( ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাব) ফিফার রেফারি ডি,কে গৃহ জুয়েল।
রাজনীতি
কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান হাজী আবদুল জাব্বর ওরফে মো: তারু মিয়া (১৮৮৭-১৯৮৫) কংগ্রেস নেতা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর সাথে ১৯২৪ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালে হাজী তারু মিয়া কুমিল্লা পৌরসভার ‘ সি’ ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন। কমিশনার থাকাকালীনই রাজনৈতিক কারণে বৃটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করেন। ১৯৩২ সাল নাগাদ কলকাতার দমদম জেলে কারাবাস করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি পুনরায় কমিশনার নির্বাচিত হন এবং মিউনিসিপ্যাল কমিটির ১৮ জন ওয়ার্ড সদস্যের অধিকাংশের ভোটে প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ঐ পদে ইস্তফা দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পুনরায় তৃতীয়বার এবং শেষবারের জন্য অধিকাংশ কমিশনারের ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, সে বছরই তিনি হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পুনরায় রাজনৈতিক কারণে কারা বন্দী হন এবং ৬৮ দিনের কারাবন্দী কালীন সময়ে চেয়ারম্যান পদপ্রর্থী হলে অধিকাংশ কমিশনারের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
কালের সাক্ষী হাজী তারু মিয়ার বর্ণাঢ্য জীবনে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।
( সূত্র : হাজী তারু মিয়া ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট ‘৯১ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিয়র, ‘শতাব্দীর উজ্জ্বল পথিকৃৎ হাজী তারু মিয়া ‘ – আবু জাফর)
হাজী তারু মিয়ার সুযোগ্য পুত্র আনসার আহমেদ (১৯৪৭-১৯১৪ ইং)। তিনি সর্ব শেষ জেনারেল এরশাদের শাসনামলে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৮৬, ১৯৮৭ সালে কুমিল্লা সদর আসনে দুইবার সাংসদ নির্বাচিত হন এবং ১৯৯০ সালে কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নয় মাস দায়িত্ব পালন করেন।
হাজী তারু মিয়ার প্রপৌত্র সফিকুল ইসলাম শিকদার আশির দশকে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। আগুন ঝরা বক্তা সফিক শিকদার ২০২৪ সালে ইন্তেকাল করেন।
নবাব ফারুকী
মোগলটুলীর বিখ্যাত ফারুকী হাউজের প্রতিষ্ঠাতা কাজী গোলাম মহিউদ্দিন ফারুকী (১৮৯০-১৯৮৪ ইং)। তিনি কুমিল্লা পৌরসভার কমিশনার থেকে বংলার মন্ত্রী হয়েছিলেন। বৃটিশ সরকার তাঁকে খান বাহাদুর, নওয়াব ও স্যার উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৩৭ সালে কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্না “ফারুকী হাউজে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় তাঁর নিজের বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন নি: সন্তান। ( তথ্য সূত্র : কুমিল্লার স্মরণীয় বরণীয়, এম,এ কুদ্দুস, মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা, আবুল কাশেম।
বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, কুমিল্লা। কুমিল্লা জেলার ইতিহাস।)
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

আরো পড়ুন