আখেরি চাহার শোম্বা কি ও কেন? — গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন আখেরি চাহার শোম্বা। নবীপ্রেমী মুসলমানরা বিশেষভাবে এদিনটি উদযাপন করে থাকেন।
আখেরি চাহার শোম্বা কী?
হিজরি সনের দ্বিতীয় মাসের নাম সফর। এ মাসের শেষ বুধবারকে বলা হয় আখেরি চাহার শোম্বা। আক্ষরিক অর্থে শব্দটি তা-ই বুঝায়। ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ আরবি ও ফার্সি শব্দের সংমিশ্রণে গড়ে উঠা একটি দিনের নাম। আখেরি আরবি শব্দের অর্থ শেষ। চাহার শোম্বা ফারসি শব্দের অর্থ বুধবার।
বিশেষ দিন কেন, কারণ কী?
রাসুলে করীম (সা.) দুনিয়ার জীবনের শেষ দিকে বেশ কিছুদিন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একদিন তিনি অনেকটা সুস্থতা বোধ করেন। পরে গোসল করেন এবং মসজিদে নববীতে ইমামতি করেন। এরপর তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকদিন পর তাকে সুস্থ্য অবস্থায় দেখে সাহাবাগন খুবই আনন্দিত হন। পরবর্তীতে নবীর (সা.) প্রতি ভালোবাসা থেকে এইদিনটি মুসলমানদের কাছে আনন্দের দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে এ দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয় ।
কেন পালিত হয় এ দিবস?
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনে আখেরি চাহার শোম্বা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহজগত ত্যাগ করার পূর্ববর্তী সময়ে এই দিনটিতে কিছুটা সুস্থতা বোধ করেছিলেন। ফারসিতে এ দিনটিকে আখেরি চাহার শোম্বা নামে অভিহিত করা হয়। আগেই বলেছি, ফারসি শব্দমালা আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনে তাঁর পার্থিব জীবনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন বলে দিনটিকে মুসলমানরা প্রতিবছর ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন। তারা নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দিবসটি অতিবাহিত করেন। উম্মতে মুহাম্মদির আধ্যাত্মিক জীবনে আখেরি চাহার শোম্বার গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম।
আখেরী চাহার শোম্বার তাৎপর্য
আল্লাহ তা’য়ালার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পৃথিবীতে তেষট্টি বছর হায়াত পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কখনোই তিনি বড় ধরনের কোনো রোগ-ব্যাধির কবলে পড়েননি। অবিশ্বাসী অংশিবাদীদের শত অত্যাচার ও নির্যাতনের মাঝেও বিশ্বময় প্রতিটি মানুষের কানে তাওহিদের অমীয় বানী ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন অটল অবিচল। পার্থিব নিয়ম মেনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমাবেন পরকালের পথে। মিলিত হবেন মহান মালিকের সান্নিধ্যে। এটাই আল্লাহ পাকের ফয়সালা। তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তুলে নিবেন পৃথিবী থেকে। তার আগে রোগাক্রান্ত হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলে উম্মুহাতুল মু’মিনীনগনসহ, সাহাবা আজমাইনগণ খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অসুস্থাবস্থা বৃদ্ধির একপর্যায়ে সফর মাসের বুধবার আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন।
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তায়া’লা আনহাকে ডেকে বললেন, ‘আয়িশা, আমার কাছে এসো ও আমার কথা শোনো।’হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তায়া’লা আনহা দৌড়ে চলে এলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! বলুন, আমাকে কি জন্য ডেকেছেন।’
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আয়িশা, আমার মাথাব্যথা চলে যাচ্ছে এবং আমি সুস্থতা অনুভব করছি। হাসান, হোসাইন ও মা ফাতিমাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।’
হযরত আয়িশা রাদিআল্লাহু তায়া’লা আনহা তাই করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মাথায় পানি ঢাললেন। তাঁকে সুন্দরভাবে গোসল করালেন। এই খবর মদীনার সকল স্থানে ছাড়িয়ে পড়লো। অনেক সাহাবী এই খবর পেয়ে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে গেলেন। কেউবা দাস মুক্ত করে দিলেন। কেউবা উট দান করলেন। কেউবা বহু দান-সাদকা করলেন। সাহাবীরাও অনেকে রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়ার নামাজ ও দোয়া করলেন।
এটা ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এজন্য এই দিনটিকে আখেরী চাহার শোম্বা বলা হয়। আখেরী অর্থ শেষ আর চাহার শোম্বা হলো বুধবার। এটাই ছিল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনের শেষ বুধবার। এরপর বৃহস্পতিবার হতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বেই তাঁর পরম বন্ধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়া’লার সান্নিধ্যে পৌঁছানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। একজন মুসাফির যেমন দূরবর্তী সফরে বের হওয়ার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়, সব কিছু গুছিয়ে নেয়- যা দেখে অনুভব করা যায় যে, উনি কোনো সফরে বের হবেন। ঠিক তদ্রূপ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুনিয়ার জীবন থেকে চলে যাবার আগেই তাঁর বিদায় যাত্রার প্রস্তুতি দেখে নিকটতম সাহাবীরা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোধ হয় আমাদের মাঝে আর বেশি দিন থাকবেন না। উদাহরণ স্বরূপ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ই’তিকাফ পালন করতেন। প্রত্যেকবার রমজানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আসতেন এবং একবার সমস্ত কোরআন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাতেন। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সমস্ত কোরআন শরীফ জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে একবার শুনাতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর জিব্রাইল আলাইহিস সালাম রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ন কোরআন দু’বার শোনালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে পুরো কোরআন দু’বার শোনালেন। এর পর বিদায় হজ্বের ভাষণের মাঝে তিনি বললেন, ‘আজকের দিন যেসময় তোমাদের মাঝে আমি একত্রিত হয়েছি। আর হয়তো তোমাদের মাঝে আমি এখানে একত্রিত হতে পারবো না।’ প্রিয় নবীর জবান মোবারকের কথা থেকে অনেক সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পারছিলেন, প্রাণের প্রিয় নবীজিকে হয়তো আর বেশি দিন আমাদের মাঝে পাব না। যা হউক, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সুস্থতা ও নেক হায়াত নসিব হউক। আমিন।।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, সাংবাদিক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি -বুড়িচং প্রেসক্লাব , কুমিল্লা।০১৭১৮-২২৮৪৪৬