দিনটা কতো পবিত্র জানো?

।। এইচ.এম. সিরাজ।।
মানুষ। বড়োই বৈচিত্রময় একটি প্রজাতি। ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন্ বলি রে পাগল মন।’ বাউল রশিদ উদ্দিনের এই গানই বলে দেয়, মানুষের মাহাত্ম্য। ‘মূর্খরা বলি শোন/ মানুষ আনিছে ধর্ম/ ধর্ম আনেনি কো মানুষ কোনো।’ এমনি অসংখ্য পংক্তিতে কবি নজরুল গেয়ে গেছেন মানুষেরই জয়গান। আবার এই মানুষই কদাচ ধর্ম-বর্ণ-সামাজিকতা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে এমন কিছু কর্মকা-ও করেন যাতে ধিক্কার জানাবার মতো ভাষাও থাকেনা। একাত্তর বাংলাদেশ নামক দেশটির গোড়াপত্তনের ঘটনাবহুল একটি অধ্যায়। ঐতিহাসি সেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জমিনে একদল মানুষ এমনতর কর্মও করেছিলো, তারাও কিন্তু মানুষ; অন্য কোনো প্রজাতি নয়।

inside post

একাত্তরে সেদিন ছিলো ঈদের দিন। পবিত্র এই দিনটিতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৯ জন কারাবন্দি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিলো তাদেরই এদেশীয় দোসরদের সহায়তায়। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদের দিনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসাও হয় আমাদের এই সোনার বাংলায়। একাত্তরে ঈদুল ফিতর কেমন ছিলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নতুন প্রজন্ম অনেকেরই অজানা।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেদিনকার ঈদের জামাতে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিলো একেবারে হাতেগোনা। বাড়ি বাড়ি হুমকি দিয়ে কিছু লোককে জমায়েত করা হয়েছিলো। ঈদগাহ্ মাঠটা (গোকর্ণ সড়কে কাজীপাড়া এলাকায় অবস্থিত জেলা ঈদগাহ্ ময়দান) তখনকে ছিলো অনেক ছোট, বর্তমান আয়তনের এক তৃতীয়াংশ। ভয়ে এবং হুমকিতে সেদিন কয়েকটি কাতার ভরেছিলো। যারা গিয়েছিলেন, তারাও কখন নামাজ শেষ হবে সেই অপেক্ষায় উসখুস করছিলেন। কারোর ভাবনাতেই ছিলোনা, সকলের অলক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেই দিন কি ঘটতে চলেছে। শহীদ সিরু মিয়া দারোগা, তার সন্তান শহীদ কামাল আনোয়ার, শহীদ নজরুলসহ ৩৯ জনকে সেই ঈদের দিনই কারাগার থেকে বের করে এনে দক্ষিণ পৈরতলায় (রেললাইনের পাশে গণকবরের কাছে) ব্রাসফায়ারে হত্যা করে গণকবর দেয় পাকিস্তানি সেনা এবং তাদেরই এদেশীয় দোসর রাজাকারেরা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবজেলে বন্দি ছিলেন ১৫ বছরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তী সময়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

গোলাম আযমের ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ মামলার ১৪তম সাক্ষী হিসেবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হৃদয় বিদারক বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘রোজার ঈদের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলের দরজা খুব জোরে শব্দ করে খুলে যায়। আমরা সকলে চমকে উঠি। জেলের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে খুব উচ্চস্বরে লাইন আপ, লাইন আপ বলে চিৎকার করে। আমরা এ শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলাম। ওই কথা শুনে আমরা জেলের গারদ থেকে বেড়িয়ে কংক্রিটের মেঝেতে লাইন দিয়ে বসে পড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন আলী রেজা এবং লে. ইফতেখারকে দেখতে পাই। এরপর ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ এবং অনেক রাজাকারসহ পেয়ারা মিয়াকে দেখতে পাই। ক্যাপ্টেন আলী রেজা তখন আঙ্গুল তুলে একজন একজন করে দাঁড় করাতে থাকেন। আমাকে একা রেখে এভাবে ৪৩ জনকে দাঁড় করায়। তখন আমি ভেবেছিলাম, এখন বুঝি আমাকে হত্যা করা হবে। আমি সাহস করে ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহকে প্রশ্ন করি, আমাকে নাকি ওদেরকে মারবে? সাদুল্লাহ তখন আমার হাত ধরে বলে, ‘আজকের দিনটা কতো পবিত্র জানো? আজকের এই দিনে কোনো মানুষকে হত্যা করা হলে সে সরাসরি আল্লাহর কাছে চলে যাবে।’ তখন আমি জিজ্ঞেস করি, তবে এই ৪৩ জনকে হত্যা করবেন? সাদুল্লাহ হাসিমুখে ‘সেটা করবো’ বলে জানান। এ সময় আমার সঙ্গে থাকা মানিক, মাহবুব ও খোকাকে আমার সঙ্গে রাখতে বলে আমাকে মারা হবে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, যেহেতু দুইদিন পর আমাকে ধরে আনা হয়েছে, এজন্য আমাকে আরও দুই দিন পর মারা হবে। ৃ…….. তখন তিনজনকে আলাদা করে রাখা হয়। এরপরই আমি নজরুল ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনি তো পালিয়ে গেলেন না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই রে। এই লুঙ্গিটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিস।’ একটি সিগারেটের টুকরা দেখিয়ে সেটিও দিতে বলেন।

কামাল আনোয়ারের বাবা সিরু মিয়া দারোগা বারবার কাঁদছিলেন। তখন কামাল তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলেন, ‘বুলবুল, যদি কোনো দিন রাস্তায় কোনো পাগলিকে দেখিস, তাহলে মনে করিস, ওটাই আমার মা।’ তখন নজরুল বলেছিলেন, ‘যখন কোনো পাকিস্তানি আর্মি দেখবি, তখন একটা করে মাথায় গুলি করবি। কুমিল্লার বাতেন ভাই তার গায়ে থাকা চাদরটি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তার সেই চাদর দিয়ে আমি প্রত্যেকের চোখের পানি মুছে দিয়েছিলাম। এরপর তাদেরকে (৪০ জন) নিয়ে যাওয়া হয় এবং আমাদেরকে গারদে আটকে রাখা হয়। আমার জানামতে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে জেল গেইট থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরের দিন আমি জানতে পারি, স্টেশনের পশ্চিমে পৈরতলা নামক স্থানে তাদেরকে এক নাগাড়ে হত্যা করা হয়েছে।’

যুদ্ধ মানেই শত্রুতা, শত্রুতে-শত্রুতে তীব্র প্রতিযোগিতার খেলা কিংবা লড়াই। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষকে মারা হয়ই, শত্রুপক্ষকে কচুকাটাও করা হয়, এটাই চিরাচরিত হিসেব। যুদ্ধের ময়দানে কাতারে কাতারে মানুষ মারা পরবে, শত্রুপক্ষের দুর্বলতর ব্যক্তিটিকেও রেহাই দেয়া যাবে না, এর ব্যত্যয় নেহায়েতই আশাতীত। কিন্তু তাই বলে ‘আজকের দিনটা কতো পবিত্র জানো? আজকের এই দিনে কোনো মানুষকে হত্যা করা হলে সে সরাসরি আল্লাহ্’র কাছে চলে যাবে।’ এমন কপটতাময় দোহাই দেয়ার কিই-বা তাৎপর্য থাকতে পারে?

তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাক্ষ্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব।

আরো পড়ুন