নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা–মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

 

inside post

নৈতিক মূল্যবোধ সমাজকে সকল প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ থেকে দূরে রাখে। ফলে মানুষ সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকে। একটি সমাজকে চেনা যায় সে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের গভীরতা দিয়ে। ধর্মীয় অনুশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপাদান নৈতিক মূল্যবোধে সঞ্জিবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে। শুধু মাত্র সামাজিক অবক্ষয় রোধের জন্যই নয় বরং জীবন সৌন্দর্যের জন্য নৈতিক মূল্যবোধ প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তার নীতিতে অটল থাকে, মূল্যবোধের উপর আস্থা রাখে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ ব্যক্তি পর্যায় একজন মানুষকে সঠিক ও শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিক মূল্যবোধ থাকার কারনেই মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ শিক্ষিত একজন মানুষ অন্যকে উৎসাহিত করে নীতিবান হতে, মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাতে। যার মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে সে অন্যায় অপরাধ করে না। বরং সে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে।নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের রয়েছে বহুমাত্রিক প্রভাব। নিম্নে নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের ভূমিকা আলোচনা করা হলো

যে মৌলিক ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নীতি প্রনয়ন করা হয়, সহজ অর্থে তাকেই নৈতিকতা বলা হয়। প্রচলিত ইংরেজতে Morality (নৈতিকতা) Righteousness (ন্যায়পরায়নতা) Goodness (উৎকৃষ্টতা) Riligiousity (ধার্মিকতা) Obedience (কর্তব্য পরায়নতা) ইত্যাদি বুঝায়। অর্থাৎ যে উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর চিন্তা চেতনা, নীতি প্রনয়নে ভূমিকা পালন করে তাকেই নৈতিকতা বলা যেতে পারে।নৈতিকতা হলো নীতি সম্পর্কিত বোধ, এটি একটি মানবিক গুনাবলী যা অন্য আরো অনেক গুণের সমন্বয়ে তৈরী হয়। মানুষ তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের উপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি খুব সচেতনভাবে মেনে চলে। সমাজ বা রাষ্ট্র আরোপিত এই সব নিয়ম-নীতি ও আচরণবিধি মানুষের জীবন-যাপনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা, নীতির চর্চাই হলো নৈতিকতা।নৈতিকতা হলো কোনো মানদন্ড বা নীতিমালা যা নির্দিষ্ট কোন আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে। নৈতিকতাকে “সঠিকতা” বা “ন্যায্যতা”-ও বলা যায়।

দীর্ঘদিন একই সমাজে একসাথে বাস করার ফলে অর্জিত মানবীয় অভিজ্ঞতা থেকে মূল্যবোধ গড়ে উঠে। মূল্যবোধের ভিত্তি হলো ধর্ম, দর্শন, দীর্ঘ দিনের লালিত আচরণ-বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও নিয়ম-নীতি। সমাজে বিদ্যমান রীতি-নীতি ও প্রথার প্রেক্ষিতে ভালো-মন্দ, ভুল-সঠিক, প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা সে গুলোই হলো মূল্যবোধ।

 

সমাজবিজ্ঞানী R.T. Schaefer তার Sociology  গ্রন্থে বলেন – Values are collective what is considered good desirable and proper (or bad, Undesirable, and improper) in a culture.

 

সমাজবিজ্ঞানী David Popenoe তাঁর Sociolog ’ গ্রন্থে বলেন যে মূল্যবোধ হলো -Idea Shared by members of a Society about what is good and bad, right & wrong, desirable and Undesirable. অর্থাৎ ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক কাঙ্কিত-অনাকাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের যে ধারণা তার নামই ম্ল্যূবোধ।

নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে শৃঙ্খল ও ন্যায় সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত। নৈতিক মূল্যবোধ বলতে কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাসকে বুঝায়। যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাই নৈতিক মূল্যবোধ। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও শিষ্টাচার মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বড়দের সম্মান করা, আর্তের সেবা করা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা প্রভৃতি নৈতিক মূল্যবোধের উদাহরণ। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তির মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তা বিকাশ করে; এটি সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, খেলার সাথী, সমাজ ও প্রথা থেকে একজন শিশু মূল্যবোধ লাভ করে। আবেগি ও আদর্শগত ঐক্যের ধারণার মাধ্যমে মনস্তাত্তিকভাবে একজন মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে, যা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে সুশৃঙ্খল ও উন্নত করে। এই নৈতিক মূল্যবোধ নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়ায় ধর্ম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।

ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক ও সামগ্রিক জীবনে পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে। এই ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের আত্মিক ও মনোজাগতিক উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের দৃষ্টিভঙ্গীর পণ্ডির বাহিরে এক পবিত্র চেতনার উম্মেষ ঘটায়। যা শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মীয় নির্দেশনা ব্যক্তি চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধারন ও প্রতিপালনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। এই গুণরাজি এক একটি কর্তব্য পালন এবং এক একটি মর্যাদা লাভের জন্যে মানুষের ভিতর থেকে ক্রমাগত তাকিদ ও দাবী জানাতে থাকে। এর ফলে প্রতি পদক্ষেপেই ব্যক্তির সদুপদেশ ও সতর্কবাণীর চাদরে বেষ্টিত থাকে। ধর্মীয় এ নির্দেশনা ও পন্থাসমূহ নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই চারিত্রিক বৈশিষ্টাবলী অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মহান প্রভূর গুনে গুনান্বিত হতে আলকুরআনে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে (বাকারা:১৩৮।)।

 

পবিত্র বেদে বলা হয়েছে, হে নেতা! হে পুরোধা! ঈশ্বরের গুণাবলিতে গুণান্বিত হও’ (যজুর্বেদ: ১.১৮)।’ স্রষ্টার গুনে নিজেকে এবং জগতকে রাঙ্গানোর মাধ্যমে মানুষের মৌলিক মানবীয় গুনাবলীর বিকাশ ঘটে, শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন মনন গড়ে উঠে। নৈতিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হয়। ধর্মের বাণীসমূহ এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্মে নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য ধর্মীয় নির্দেশনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলোচনা করা হল

কল্যাণ কামনা

হাদীসে কল্যাণ কামনার জন্যে ‘নসিহত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থপূর্ণ। এ কারণে নবী সা. এ পর্যন্ত বলেছেন ‘দ্বীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা’। এ বাক্যটি তিনি এক সঙ্গে তিনবার উচ্চারণ করেছেন (সহীহ মুসলিম)। বিশ্বাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অপরের পছন্দ-অপছন্দের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন, তার কসম! কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করবে’ (বুখারী ও মুসলিম)।বাইবেলে বলা হয়েছে, যারা অন্যায়ের বীজ বপন করে এবং অনিষ্টের চারা রোপন করে তারা অন্যায়-অনিষ্টের ফসলই ঘরে তোলে’ (ইয়োব, ৪:৮)।’

আত্ম ত্যাগ

অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া চরিত্রের অন্যতম মৌলিক গুণ। নিজের প্রয়োজনকে মুলতবী রেখে অন্যের প্রয়েজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অন্যের প্রয়োজন মেটানো এটিই আত্মত্যাগ। নিজে কষ্ট স্বীকার করে অন্যকে আরাম দেবে। নিজের জন্যে দরকার হলে স্বভাব-প্রকৃতির প্রতিকূল জিনিস মেনে নেবে,কিন্তু স্বীয় ভাইয়ের দিলকে যথা সম্ভব অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে রক্ষা করবে। আলকুরআনে এ গুনটির প্রশংসায় বলা হয়েছে, ‘এবং তারা নিজের উপর অন্যান্যদের (প্রয়োজনকে) অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা রয়েছে অনটনের মধ্যে’ (হাশর: ৯)।’বেদে বলা হয়েছে, যে ক্ষুধার্ত সঙ্গীকে অভূক্ত রেখে একাই ভূরিভোজ করেএবং যে স্বার্থপর তার সাথে কখনো বন্ধুত্ব করো না’ (ঋগবেদ:১০.১১৭.৪)।

সুবিচার

সামাজিক সুবিচার সর্বমহলে পরম কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত এক বিষয়। ইসলামে বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং আমি তাদের (রাসুলদের) সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও মানদণ্ড, ন্যায়নীতিÑ যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে’ (রাহমান:৯, নাহল:৯)।কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়া ৭ ব্যক্তির প্রথম ব্যক্তি হবেনÑ ন্যায় বিচারক’ (সহীহ বুখারী)।

সদাচরণ

পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সদাচরণের গুরুত্ব অনেক বেশী। অন্যায় করলেও তার জবাব ন্যায়ের দ্বারা দিবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা অন্যায় ও পাপকে ন্যায় ও পুণ্যের দ্বারা নিরসন করে থাকে’ (কাসাস:৫৪)।রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবো; যে আমাকে (অধিকার থেকে) বঞ্চিত করবে আমি তাকে (তার অধিকার) বুঝিয়ে দেব এবং যে আমার উপর যুলুম করবে আমি তাকে মার্জনা করে দেবো’ (সহীহ বুখারী)।

ধম্মপদে বলা হয়েছে, ভাল কাজ সবসময় কর।বারবার কর। মনকে সব সময় ভাল কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ’ (পাপবগগো: ১১৮)। রাসূল বলেছেন, সদাচরই ধর্ম’ (সহীহ মুসলিম)।বেদে বলা হয়েছে, সত্যিকারের ধার্মিক সব সময়ে মিষ্টভাষী ও অন্যের প্রতি সমর্মী’ (সামবেদ:২.৫১)।
নম্র ও ভালবাসাময় ব্যবহার

 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের উপর নরম দিল ও সদয় হয়েছেন। যদি তাদের সাথে বদমেজাজী ও কঠিন মনের হতেন তাহলে লোকেরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত’ (ইমরান: ১৫৯)।রাসূল বলেছেন, ‘বিশ্বাসী হচ্ছে প্রেম ভালবাসার উজ্জ্বল প্রতীক। যে ব্যক্তি না কাউকে ভালবাসে, আর না কেউ তাকে ভালবাসে, তার ভেতর কোন কল্যাণ নেই’ (আহমাদ ও বায়হাকী)।তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি কোমল স্বভাব থেকে বঞ্চিত সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’ (সহীহ মুসলিম)।রাসূল সা. আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়’ (সুনানেতিরমিযী)।

 

মার্জনা ও ক্ষমা আল্লাহ তায়ালা বলেন, নম্রতা ও ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো’ (আরাফ:১৯৯)। আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন, তাদের জন্য ক্ষমার প্রার্থনা করুন’ (ইমরান: ১৫৯)।রাসূল সা. বলেছেন, নিশ্চয় ক্রোধ ঈমানকে এমনিভাবে নষ্ট করে দেয়, যেমন বিষাক্ত ঔষুধ মধুকে নষ্ট করে’ (সহীহ বুখারী)।নবী সা. বলেছেন, মুসা আ. আল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করেন, বান্দার ভেতর কে তোমার কাছে প্রিয়? এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেয়’ (বায়হাকী)।

ক্রোধ নিবারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা স্বচ্ছলতায়ও অভাবের সময়ব্যয়করে যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন’ (ইমরান, ৩:১৩৪)।বেদে বলা হয়েছে, জীবনের প্রতিটি স্তরে অনিয়ন্ত্রিত রাগ ক্রোধথেকে দূরে থাকো’ (গামবেদ: ৩০.৭)। বেদে আরো বলা হয়েছে, ধনুকের তীর নিক্ষেপের ন্যায় মন থেকে ক্রোধকে দূরে নিক্ষেপ করো। তাহলেই তোমরা পরস্পরের বন্ধু হতে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে’ (অথর্ববেদ: ৬.৪২.১)।

 

হাদীসে এসেছে, সে প্রকৃত বীর নয়, যে মল্ল যুদ্ধে শত্রুকে পরাভূত করে, প্রকৃত বীর সেই যে নিজের ক্রোধকে দমন করে, (মিশকাত)। ধম্মপদে বলা হয়েছে, রণক্ষেত্রে সহস্রযোদ্ধার উপর বিজয়ীর চেয়ে রাগ-ক্রোধ বিজয়ী বা আত্মজয়ী বীরই বীরশ্রেষ্ঠ’ (সহস্সবগ্গো, ১০৩)। ভগব˜্ গীতায় বলা হয়েছে, কাম-ক্রোধ-লোভ- এই তিনটি নরকের প্রবেশদ্বার। এই তিনটি বিষবৎ পরিত্যাজ্য’ (দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ: ২১)।

নির্ভরতা

যে বক্তি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য, যার কাছে মানুষ তার সমস্ত গোপন বিষয়াদি পূর্ণ নিশ্চিন্তার সাথে প্রকাশ করতে পারে, তাকেই বলা হয় বন্ধু। আর মানুষ তার সঙ্গীর উপর নির্ভল করবে এবং জীবনের তাবৎ বিষয়ে তাকে বরাবর শরীক করবে, ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এটাইতো দাবী করে। এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন. ‘বিশ্বাসীরা ভাই-ভাই’ (হুজরাত।

পরিশ্রম প্রিয়তা আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের পরিশ্রম প্রিয় করে তৈরী করেছি’ (বালাদ: ৪০)। বেদে বলা হয়েছে, অলস মস্তিষ্ক কুচিন্তার সহজ শিকার’ (ঋগবেদ:১০.২২.৮)।বেদে আরোবলা হয়েছে, হে নেতা! হে পুরোধা! পাহাড়ের মতো দৃঢ় ও অজেও হও। কর্তব্য পালনে সবসময় অবিচল থাকো’ (যজুর্বেদ:১২.১৭)। বেদে আরো বলা হয়েছে, হে মানুষ! স্বনির্ভর হও, বাহিরের সাহায্যের দাসে পরিণত হয়োনা’ (যজুর্বেদ: ৬.১২)। আরো বলা হয়েছে, হে মানুষ! উৎসা উদ্দীপনা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে পরিশ্যম করো। দারিদ্র ও সুস্থতা তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে’ (অথর্ববেদ: ৬.৮১.১)। ধম্মপদে বলা হয়েছে, গন্ধহীন পুষ্পের ন্যায় কর্মবর্জিত সুন্দর বাক্যমালাও নিষ্ফল’ (পুপ্কবগগো: ৫১)। বাইবেলে বলা হয়েছে, তুমি চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। খোঁজ কর, পবে। দরজা খটখট কর, দরজা খুলে যাবে’ (মথি, ৭:১২)। বাইবেলে আরো বলা হয়েছে, পরিশ্রমী হাত সবসময় কর্তৃত্ব করে আর অলস পরিণত হয় পরাধীন দাসে, (হিতোপদেশ, ১২:২৪)।

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। এই প্রবাদটিকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই যেন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা থেকে সব ‘ভালো’ এক প্রকার উঠে যাচ্ছে। আগে মানুষ বিশ্বাস করতো দানের চেয়ে মান বড়। অথচ এখন এই ধারণা পাল্টে গেছে। প্রত্যেকেই এখন অবিরাম ছুটে চলেছে অর্থ সম্পদ ও ভিত্তের পেছনে। একজনকে পেছনে ফেলে আর একজনের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযেগিতা প্রত্যেককে করে ফেলেছে অন্ধ। প্রত্যেকে অবলীলায় বিসর্জন দিচ্ছে নিজস্ব নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে।

 

তাই এখন পুরো সমাজদেহ অনেকটা ডুবে গেছে দূর্নীতি, অপকর্ম আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে মানুষ এমন করে নির্বাসিত করেছে যে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রধানরাও হর-হমেশাই জেলে যাচ্ছেন দূর্নীতির দায়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আজ নীতিহীনতায় জর্জরিত। মূল্যবোধ চর্চাকে এখন বোকাদের কাজ বলে বিদ্রƒপ করা হয়। একটা সময় ছিল যখন একজন দরিদ্র অথচ নীতিবান মানুষকে সকলেই সম্মান করত। আর এখন টাকা যার সম্মান তার। তাই আমরা ঘোষখোর, দুর্নীতি পরায়ণ আর সুদ-কারবারী মহাজনদের সম্মান করি, সংবর্ধনা দেই।আমাদের দেশের যুবসমাজের দিকে তাকালে এই নৈতিক অবক্ষয়ের এক করুণ ও প্রত্যক্ষ চিত্র আমরা দেখতে পাই। লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এই অবক্ষয়ের কারণে নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের পথে, আসক্ত হচ্ছে মাদকে। ছিনতাই, অপহরণ গুম, খুন, হানাহানি, নষ্ট রাজনীতি আর সন্ত্রাসে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে গলা টিপে হত্যা করে মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সব বয়সী মানুষ আজ চলেছে ধ্বংসের পথে। যে ছেলেটির হওয়ার কথা শিক্ষক, চিকৎসক, প্রকৌশলী বা প্রশাসক সে আজ হয়ে যাচ্ছে চোরাচালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা সন্ত্রাসী। যার দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে আজ অন্যায় করে ব্যাহত করছে দেশের অগ্রযাত্রাকে। এসব কিছুর জন্য আসলে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই দায়ী।এই অবস্থা চলতে থাকলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে কিছুদিন পরে রূপকথার গল্পে খুঁজতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, একটি জাতির নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সেই জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতি-প্রকৃতি ও অবস্থানকে তুলে ধরে। যে জাতি যত বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে জাতি তত বেশি মজবুত ও সুসংহত। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে ন্যায়ের পথে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। অন্যায় অবিচার করা থেকে মানুষকে দূরে রাখে। সেই হিসেবে নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে ধর্মের তীব্র প্রভাব রয়েছে। যে ব্যক্তি ধর্মীয় অনুশাসনে যত বেশী অভ্যস্ত এবং নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত সে নিজের মূল্যবোধকে সম্মান করে সে সর্বদাই নিষ্কলুষ থাকার চেষ্টা করে।




মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
(আইবিএস)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরো পড়ুন