পেছনে ফিরে দেখা
।। মিতা সফিনাজ।।
বেশ ক’বছর আগের কথা। কান্দিরপাড়ে মার্কেটে ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থী দেখে এগিয়ে জানতে চাইলাম,এই তোমরা এখানে করছ কি? তারা হঠাৎ একটু কাচুমাচু ভাব,মিনমিন করে কিছু বলছে। আমি বললাম, চেনো আমাকে? এদের একজন এগিয়ে বল্ল- জ্বি চিনি আপনি আমাদের কলেজের বিএনসিসি’র টিচার! এবার আমারই চমকাবার পালা! বলে কি? যাক তাদের কলেজে যেতে বলে নিজের পথ ধরি।
হ্যাঁ, বিএনসিসি বলি আর ইসলামের ইতিহাস বলি আমি একজন শিক্ষক। কতকাল থেকে সে জানিনা। আমার আব্বা-আম্মা শিক্ষক ছিলেন ষাটের দশক থেকে। ব্যাস তাঁদের শিক্ষকতার মন্ত্র আমার মাথায় জেঁকে বসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষে আমি শুরু করলাম, ঐ পথে। প্রথমে চাঁদপুরের শাহরাস্তি করফুলেন্নেছা মহিলা কলেজে প্রায় আড়াই বছর। এরপরে ১৯৯৩ খ্রিঃ ১৭নভেম্বর চতুর্দশ বিসিএস দিয়ে পদায়ন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে। মনে আছে প্রায় ১৪জন জয়েন করেছি সেসময়। প্রথম সরকারি চাকরি। মানে স্বপ্ন ছোঁয়া। হ্যাঁ শুরুর স্বপ্ন বেশি মনে নেই। শুধু জানি মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কাজে। পড়ানো,শিক্ষক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক, বিএনসিসি,স্কাউট, ট্রেনিং কিছুই বাদ দেইনি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন সিনিয়র সহকর্মী, আর সমবয়সীরা তো ছিলেনই। রাজিয়া সুলতানা ইলি আপা,সুলতান স্যার,ইদ্রিস স্যার,শেখর রঞ্জন সাহা স্যার, হাবিবুর রহমান স্যার,মেজবাহ উদ্দিন স্যার,সফিকুল বারী স্যার, বড়ভাই জামাল নাসের,নিখিল রঞ্জন স্যার কত নাম, কত আন্তরিকতা ভোলা যায়না। প্রিন্সিপাল সুবীর কুমার চক্রবর্তী স্যার। আমার সারাজীবনে দেখা সেরা প্রিন্সিপাল। যিনি প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ছিলেন পথপ্রদর্শক।
একসময় ২০০১ এলো, আমরা সহকারী অধ্যাপক হলাম। আমার পোস্টিং হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহিলা কলেজে। কুমিল্লার বাইরে, যাতায়াতের দূরত্ব সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। কলেজের সবকিছুই ভাল কিন্তু আমি পারলামনা। প্রিন্সিপাল রাশেদা তাহিরের সহায়তায় তিনমাসের মধ্যে ফিরে এলাম কুমিল্লা কলেজে। এখানেও আমার কাজের শেষ নেই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০২সালে বিএনসিসির সবচেয়ে আকাংখিত ট্রেনিং, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে। কিন্তু বাধা দিলেন প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মদদপুষ্ট কিছু শিক্ষক। যাই হোক প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রাজি নয় অন্যদিকে কুমিল্লা শহরের সিনিয়র এবং স্বনামধন্য অনেক শিক্ষক, অন্য কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার, শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অনেক বিশিষ্টজন উৎসাহ দিয়েছেন। এরপর কুমিল্লা শহরের জনপ্রিয় সংগঠক। যাকে ছাড়া কুমিল্লার খেলাধুলা, নাটক,স্কাউটিং, বিএনসিসি, আমরা ভাবতেই পারতাম না। ফরিদ উদ্দিন সিদ্দিকী ভাইয়ের বড়ভাই ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল জালাল আহমেদ সিদ্দিকি স্যার। তিনি সেসময় বিএনসিসি মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি সরাসরি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সংগে দেখা করে এর সমাধান করেন। সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন আসলো, এখন থেকে যে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং যাবার অর্ডার আসে তাকে যেতে দিতে হবে। সারাদেশে একটা হৈচৈ এর মত পড়ে গেল। কি হলো? কেন হলো? বহুদিন এটা নিয়ে সবাই আমাকে প্রশ্ন করতো! এছাড়া আমার নামটি এমনই যে আজ অবধি সম্ভবত কোন সরকারি কলেজে আমার নামে কোন শিক্ষক নেই। যাক ট্রেনিং করে এলাম সাড়ে চার মাস। কাঁধে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট লাগতে বেশি দিন সময় নেয়নি। আমার ছাত্রজীবনে সবচেয়ে আনন্দময় সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। আর আমার দেখা সারাদেশে সেরা ইন্সটিটিউশন হচ্ছে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। কি নেই সেখানে? আসলে এমন একটি বিশেষায়িত ট্রেনিং সেন্টার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে করা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অনন্য সাহসিকতার পরিচয়। এতকিছু দেখেছি, শিখেছি আজীবন মনে রাখার মত। দিন গড়িয়ে এল ২০০৮ সাল, আবারও পদোন্নতি। কি সে উৎকন্ঠা! আর এটির জন্য সারারাত জেগে আমরা,বিসিএস সমিতির নেতৃবৃন্দ। যাক রাত ২টায় অর্ডার বেরুলো। সকাল ১০টার মধ্যে একই কলেজে পদায়ন। তবে তিনমাসের মধ্যে পোস্টিং নিয়ে যেতে হলো নোয়াখালী মহিলা কলেজে। আমার জন্মস্থানে। সেখানে প্রায় সাড়ে চারবছর ভালই কেটেছে। সেই যে আমার স্বভাব পানির ধর্ম। যেখানেই যাই তার আকার ধারণ করি। এখানেও আমি মহিলা হোস্টেল উপদেষ্টা, সাংস্কৃতিক, খেলাধুলা সবকিছুতেই জড়িয়েছি। শুধু মন পড়ে থাকতো কুমিল্লায়। এখানে পেয়েছিলাম অসম্ভব ক্লাসমুখী মেধাবী শিক্ষক প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরীকে। যিনি বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার পরিচালক শিক্ষা ও প্রশাসন। এখানেও তিনি চমৎকার দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছেন সবকিছু। পেয়েছি আল হেলাল মোঃ মোশাররফ স্যারকে,আমার প্রিন্সিপাল হিসেবে। যদিও তিনি কৈশোরকাল থেকে আমার চেনা একজন যোগ্যতম মানুষ। পেয়েছিলাম প্রফেসর বাবুল চন্দ্র শীল স্যারকে। সে কথা পরে বলবো। অনেক চেষ্টা তদবিরে এলাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ২০১৩ তে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান হিসেবে। ভীষণ আবেগের একটি কলেজ,যেখানে পেয়েছি একদল মেধাবী ছাত্র,নয়ন দেওয়ানজি,জিয়াউল আরেফিন তুহিন,কামরুল, মশিউর, সাথী কত কত নাম। আমি এদের সাহচর্যে রেডক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, নবাব ফয়জুন্নেসা ছাত্রী হলের প্রভোস্ট। চিরচেনা আমার ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আমার বিএনসিসি জীবনে র্যাংকের গতি মেজর পর্যন্ত গড়িয়ে গেলো। আমি শ্রীলংকায় ট্রেনিংয়ে গেলাম। ক্লাশের ছাত্রদের কাছে আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতেও সময় লাগেনি। সবসময়ই আমি আমার শিক্ষার্থীদের খুব কাছের মানুষ ছিলাম। এরা সবাই আমাকে ডাকতো আম্মাজান,মা! আমিও মিশতাম অনেকটাই বন্ধুর মত। যা অনেক শিক্ষকের পছন্দ ছিলনা। কুভিকে শিক্ষকের কোন অভাব ছিলনা। বিশ ডিপার্টমেন্টে ২০০শিক্ষক। কাকে রেখে কার কথা বলি! আমি জুনিয়র, সিনিয়র সবার সাথেই মিশেছি। বিলকিস ম্যাডাম,কাজী মুজিব ভাই, প্রফেসর হাসেম, প্রফেসর অম্লান কুসুম,প্রফেসর বিজিত ভট্টাচার্য স্যার, ড. মেহেদী হাসান, ফাতেমা ম্যাডাম। বন্ধুসম নিলুফার, মেহেরুন্নেছা, সুমী, মাহমুদা, এত জুনিয়র তবুও বন্ধু আজও, আজীবন। এরমাঝে কিছু যে কষ্ট ছিল তা নয়! একজন সিনিয়রের অন্যায় আবদার মানতে বিবেক বাধা দিয়েছিল। তার খেসারতে রেডক্রিসেন্ট এর দায়িত্ব, হলের প্রভোস্ট এর দায়িত্ব হারালাম, তেমন কোন কারণ ছাড়াই। ধৈর্য্য হারাইনি। বৈরী পরিবেশ ছিল নিজ বিভাগে, আমার মতের সাথে তাদের দূরত্ব ছিল অনেক। অথচ এখান থেকেই আমি প্রফেসর পদায়ন পাই ২০১৮ সালে। একটা ঝামেলায় পড়ি, প্রফেসর রতন কুমার সাহা(প্রিন্সিপাল) সেখানে আমাকে প্রকৃত অবস্থা বুঝে সাহায্য করেন। এরপরে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে এলাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে। একই সাথে প্রিন্সিপাল হয়ে এলেন প্রফেসর বাবুল চন্দ্র শীল। পূর্ব পরিচিত আমার এই প্রিন্সিপালকে মূল্যায়ন করা আমার জন্য কঠিন। এমন অমায়িক,দক্ষ, শিল্পীমনা শিক্ষক সত্যিই অতুলনীয়। আমার বিভিন্ন ভুল ত্রুটিগুলো তিনি সামলেছেন বন্ধুসুলভ দৃষ্টিতে। আর একজন প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান দেওয়ান মোঃ ইয়াসির আরাফাত। চাকরিকালীন সময়ে এ কলেজে তিনি ২০১২ সাল থেকে আছেন বিধায় আমি একদম নির্ভার। বরাবরের মত সব সামলাচ্ছেন ইয়াসির আরাফাত। এখানে আমাদের শিক্ষকগণ যথেষ্ট মেধাবী এবং খুব সহায়তা করেন। আমার সময়ও শেষ হয়ে এলো প্রায়,এখানেই আমি চাকরি শেষ করবো বেঁচে থাকলে। আমার আব্বা আম্মার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। সুশিক্ষার জন্য তারা আজীবন কষ্ট করেছেন। আমাদের সব ভাইবোনকে তাঁরা নিজ হাতেই গড়েছেন। আমি তাই কৃতজ্ঞ আমার চেনাজানা সবার কাছে। আমার এই শিক্ষকতা জীবন নিয়ে আমি আল্লাহর কাছে যত পেয়েছি ততটা আমি হয়তো দিতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি।
লেখক: অধ্যক্ষ, নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ।