প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য

।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট।।
মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতিদানকারী সকল শহীদদের অপরিসীম শ্রদ্ধা জানাই।
প্রথমেই “ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট” শীর্ষক আলোচনা মহান একুশের পূর্বাহ্নে আয়োজন করবার জন্য বিনয় সাহিত্য সংসদকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ দিচ্ছি।
একটা জাতির সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সংগ্রাম কিন্তু সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়েই রচিত হয়। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন হচ্ছে সব লড়াই, সংগ্রাম এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগঠিত আন্দোলনের সূতিকাগার।
তবে, আক্ষেপের একটা দিকও রয়েছে। কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক কর্মকান্ড আমরা দেখিনা। যদিও কুমিল্লায় ইদানিং বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য গবেষক স্বচ্ছন্দ্যে বিচরণ করছেন।
একটা কথা জানিয়ে রাখছি এ অবসরে। আমাদের এই ভূখন্ডের বাইরেও বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাঙালীরা জীবনদান করেছেন। বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দেলনে সালাম, রফিক, সফিক, জব্বার, বরকত ও আরো নাম না জানা অনেকেই তাঁদের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে শহীদ হয়েছেন।
তেমনই এই রক্তস্নাত সংগ্রামের নয় বছর পর আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দক্ষিণ-পুর্বাঞ্চলীয় আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকায় সেই বীর বাঙালীরা আত্মাহুতি দিয়েছেন মায়ের ভাষা, বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠার মহান কারনে।
আসামের বরাক উপত্যকার বাঙলা ভাষা আন্দোলন ছিলো আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাঙলাভাষী। বাঙালী ছাড়াও অসমীয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরী ও আরো কয়েকটি ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের বাস ছিল ওই অঞ্চলে।
এই গণ আন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে। সেদিন ১১জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। অর্থাৎ ঐ ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন ১১ জন। এই আন্দোলনে বাঙলাভাষার জন্য বিশে^ প্রথম নারী কমলা ভট্টাচার্য্য শহীদ হন। ১১ জন শহীদের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইল । মানে সবাই ছিলেন বাঙালী, যাঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশে।
বিশিষ্ট স্বল্পদৈর্ঘ ছায়াছবি নির্মাতা মাসুদ করিম, যিনি ২০১৯ সালে ভারতের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক অধ্যাপক আনিসুজ্জ¥ামান এবং ২০২০ সালে অমর একুশের গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবন ও কর্মভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, তিনিই আসামের বরাক উপত্যকার বাঙলাভাষা আন্দোলনের উপর গবেষণামূলক একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন।
তবে, ১৯৫২ সনের মহান ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙলাকে একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সংগঠিত গণআন্দোলন। আর বরাক উপত্যকার আন্দোলন ছিল বাংলাকে আসাম প্রদেশের দাপ্তরিক বা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য সংগ্রাম, যা মূলত: ১৯৫৯ সালে সূচিত হয়।
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত বিরাট, বিশাল, বিপুল এবং বিস্তৃত। মূল প্রবন্ধটি আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আমার ছোট্ট ভাই বিশিষ্ট সাংবাদিক মোতাহার হোসেন মাহবুব অনেক খাটাখাটুিন করে উপস্থাপন করেছেন। এ সংক্রান্ত অনেক বই, প্রবন্ধ এবং বিজ্ঞজনের মতামত এতে সন্নিবেশ করেছেন।
আমরা শুধুমাত্র কুমিল্লায় ভাষাবীর বা সংগ্রামী হিসেবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক লায়লা নূর, অ্যাডভোকেট আহমদ আলী, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম প্রমুখের নাম শুনে থাকি। এবং তাদের সংগ্রামী জীবন, আত্মত্যাগ ও অবদান নিয়েই কুমিল্লা অঞ্চলে মহান ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর বাইরেও সুদীর্ঘ মহান ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লায় আরো অনেকজনের নিস্বার্থ অবদান ও দেশমাতৃকার কারনে চরম আত্মত্যাগের ঘটনাও রয়েছে। সেই সম্পর্কে আমার পড়ালেখা, জ্ঞান ও জানাশোনা নেই বললেই চলে।
তাইতো, আজকের আলোচনা সভায় বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবেনা ভেবেই মহান ভাষা আন্দোলনের একটি নতুন দিককে তুলে ধরলাম। আপনাদের সম্মুখে।
আমি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছোট্ট সোনামণিদের বা শিক্ষার্থীদের বলি, মাতৃভাষা সঠিকভাবে চর্চা করলে, শুদ্ধ উচ্চারণে বলতে ও লিখতে পারলে, বিদেশী যেকোন ভাষাই কঠিন মনে হবেনা। একটা কথা এখানে বললে অত্যুক্তি মনে হবেনা বা আপনারা হতবাক হবেন। তা হচ্ছে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের তেতলায় অবস্থিত মিডিয়া সেন্টারে আমার সহকর্মী কয়েকজনকে দেখেছি কি স্বচ্ছন্দ্যে বাংলায় রিপোর্ট, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় ও নানা ধরনের লেখা কম্পিঊটারে টাইপ করছেন সাবলীলভাবে। তা দেখে আমার মনেও একটা জেদ চেপে বসে। তাই, মাত্র সাতদিনে প্রচেষ্টায় মোটামুটি গতিতে কম্পিউটারে বাংলায় লিখতে শিখে গিয়েছিলাম।
আবারো মহান ভাষা আন্দোলনে প্রাণ-উৎসর্গকারীদের অতল শ্রদ্ধা জানাই।

inside post

****এই প্রবন্ধটি লেখক বিনয় সাহিত্য সংসদের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে লিখিত আকারে উপস্থাপন করেন। কুমিল্লা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের একুশে উদযাপন পর্ষদ-এর আহ্বায়ক বরেণ্য সাংবাদিক খায়রুল আহসান মানিক। প্রধান অতিথি ছিলেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. নিজামুল করিম। বক্তব্য প্রদান করেন নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার, সংগঠনের একুশে উদযাপন পর্ষদ-এর সদস্য সচিব সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ এবং নিবন্ধটির লেখক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোতাহার হোসেন মাহবুব। এ উপলক্ষ্যে সংগঠনের একুশে সংকলন “ফাগুনের আগুন”-এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হলেও বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও সুরের ধারা, কুমিল্লার সদস্যরা এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নেয়। তাছাড়া, কুমিল্লার উঠতি ক’জন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান অনুষ্ঠানটিতে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।
মোবাইল ফোন: ০১৭৩১-৫১২৭২২ এবং ০১৫৫২-৩২০৯৫৭ ।

আরো পড়ুন