প্রবাসীদের রেমিট্যান্সেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ


মনোয়ার হোসেন রতন ।।
বাংলাদেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালনযন্ত্রের অন্যতম প্রধান শিরা হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। তাঁরা কেবল নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফোটান না, বরং গোটা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন। রেমিট্যান্স আজ শুধু টাকা নয়; এটি দেশের আত্মবিশ্বাস, স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনার ভিত্তি।
প্রবাসীদের ঘাম ঝরানো টাকায় গড়ে উঠছে অর্থনীতির ভিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১৭.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় এটি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তবুও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সবচেয়ে বড় অবদান রেমিট্যান্সই। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, এপ্রিল ২০২৪)
বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট (Migration and Development Brief, October 2023) অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের পরে বাংলাদেশ ৪র্থ সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রাপ্ত দেশ। এই অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সরাসরি অবদান রাখে।
যে জীবনের বিনিময়ে আসে এই ডলার
মধ্যপ্রাচ্যের তাপদগ্ধ মরুভূমি হোক, মালয়েশিয়ার নির্মাণ শ্রমিক হোস্টেল কিংবা ইতালির ফল বাগান—বাংলাদেশি শ্রমিকরা অমানবিক পরিশ্রমে দিনরাত এক করে যান। তাঁদের একটি বড় অংশ পেশাগত সুরক্ষা, আইনি সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং উপযুক্ত বেতন থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (BILS)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে মৃত্যু বরণ করেন।
তবুও এই প্রবাসীরা প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে, দেশের মাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসে থাকেন। অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, সন্তানদের বড় হতে না দেখা, নিজের শেষ দিনগুলো মাটির দেশে কাটাতে না পারার কষ্ট নিয়েও যান।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প: গ্রামীণ উন্নয়ন থেকে জাতীয় স্থিতিশীলতা
রেমিট্যান্স শুধু শহুরে ব্যাংক ব্যালেন্সেই থেমে নেই, বরং এটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়েছে। একজন সৌদি প্রবাসীর পাঠানো ২৫ হাজার টাকাই হয়তো এক পরিবারকে বছরের খরচ চালাতে সাহায্য করেছে, একজন মালয়েশিয়া প্রবাসীর পাঠানো টাকায় ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্র্যাক এবং IOM-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, রেমিট্যান্স পাওয়া পরিবারগুলোর দারিদ্র্য হার ১০ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪০% কমে এসেছে। শিক্ষায় ব্যয় বেড়েছে, গৃহ নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বেড়েছে।
সমস্যার চোরাবালি
রেমিট্যান্সের বিপরীতে রয়েছে কিছু ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় দেশে আসে, ফলে সরকার এই আয় থেকে কোনো রাজস্ব পায় না। এছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলের জটিলতা, টাকার দর কমে যাওয়া, এবং সরকারের উপযুক্ত নীতির অভাব অনেক প্রবাসীকে নিরুৎসাহিত করে। সম্প্রতি রেমিট্যান্স ইনসেনটিভ ২.৫% হলেও, তা বাস্তবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো দক্ষতার অভাব। এখনও আমাদের ৭০% কর্মী “লো-স্কিলড” কাজ করেন, যাদের আয় সীমিত এবং চাকরির নিরাপত্তা অনিশ্চিত। অথচ দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা থাকলে তারা উচ্চ আয়ের চাকরি পেতে পারতেন।
সম্ভাবনার দিগন্ত
বিশ্বব্যাপী অভিবাসন বাজার প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের কিছু দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে শ্রমবাজার খুলছে। সরকার যদি দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন, অভিবাসন নীতির আধুনিকায়ন এবং দূতাবাসগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাহলে এই খাত থেকেই আরও ২৫ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে, যেখানে প্রবাসীদের জীবন, আয়, নিরাপত্তা ও সহযোগিতার তথ্য থাকবে। একইসাথে ‘ডায়াসপোরা বন্ড’ বা ‘প্রবাসী বিনিয়োগ স্কিম’ চালু করে রেমিট্যান্স অর্থকে শিল্পায়নে পরিণত করা যেতে পারে।
কিছু প্রস্তাবনা
১. রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে ব্যাংকিং চ্যানেলের ফি হ্রাস এবং তাৎক্ষণিক টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। ২. হুন্ডি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা ও সচেতনতামূলক প্রচার। ৩. দক্ষতা উন্নয়নে প্রতিটি জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। ৪. নারী অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভিসার জালিয়াতি রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। ৫. প্রবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য বীমা ও আইনি সহায়তা প্ল্যাটফর্ম গঠন।
প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এখন আর শুধুই অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, এটি এক ধরনের আত্মত্যাগের প্রতীক। তাদের রক্ত-ঘামে অর্জিত টাকায় দেশ চলছে, গ্রাম উন্নত হচ্ছে, অর্থনীতি সচল থাকছে। তাই তাদের সম্মান, সুরক্ষা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা কেবল কৃতজ্ঞতা নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাদেশ ব্যাংক (https://www.bb.org.bd)
বিশ্ব ব্যাংক (World Bank Migration and Remittance Brief 2023)
ব্র্যাক গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (BILS)
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM)