ভাংতি পয়সা: রাষ্ট্রীয় অবহেলায় মুদ্রার মর্যাদাহানি


মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাজারে এক টাকা, দুই টাকা কিংবা পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রা হাতে পেলেই যেন বোঝা মাথায় উঠে। দোকানি নেয় না, রিকশাচালক ফিরিয়ে দেয়, ব্যাংক কর্মকর্তারা নাক ছিটকান—এ যেন বৈধ অথচ অবজ্ঞাত এক নিষিদ্ধ মুদ্রা! অথচ এসব কয়েনই বাংলাদেশের মুদ্রানীতির আইনসম্মত প্রতিফলন। তাহলে প্রশ্ন উঠে—কেন এই আইনি মুদ্রা কার্যত অচল?
মুদ্রার ইতিহাস ও বাস্তবতাঃ
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রথম কয়েন চালু করে—৫, ১০, ২৫, ৫০ পয়সা। পরে আসে এক, দুই ও পাঁচ টাকার কয়েন। যদিও ২০১৩ সালে দশ টাকার কয়েন ছাপা হয়, তবে তা কখনো বাজারে পুরোপুরি প্রচলিত হয়নি—আজও নেই।
মূলত গণপরিবহন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও দৈনন্দিন কেনাবেচায় সুবিধার জন্যই কয়েনের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। কিন্তু আজ বাস্তবে এই মুদ্রাগুলো বাজারচ্যুত, অর্থনীতির মূল প্রবাহ থেকে ছিটকে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাজারে কয়েনের পরিমাণঃ
১ টাকা: প্রায় ৯০০ কোটি টাকা
২ টাকা: প্রায় ১১০০ কোটি টাকা
৫ টাকা: প্রায় ১২০০ কোটি টাকা
১০ টাকা কয়েন: মুদ্রণ হয়েছে, কিন্তু বাজারে নেই।। মোট পরিমাণ: প্রায় ৩৫৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের মুদ্রা ঘরে ঘরে জমে আছে, অথচ তার কোনও ব্যবহার নেই। যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের এক ভয়াবহ অপচয়।
মূল সমস্যাগুলো কী?
১. ব্যাংকের অনীহাঃ
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট (২০২৩) অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৭৮% শাখা কয়েন নিতে চায় না। অনেক কর্মকর্তা জোর করে কয়েন নিতে গেলে গ্রাহকদের হয়রানি করেন।
২. বাজারে গ্রহণযোগ্যতার অভাবঃ
চালক, দোকানি, খুচরা বিক্রেতা কেউই কয়েন নিতে চায় না। কারণ, এগুলো খরচ করা ঝামেলাপূর্ণ।
৩. প্রযুক্তিগত ঘাটতিঃ
দেশের অধিকাংশ ব্যাংকে নেই কয়েন গণনার মেশিন। ফলে হাতে গুনে জমা নিতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও দুর্নীতিপ্রবণ।
৪. জাল কয়েনের ভীতিঃ
কিছু এলাকায় জাল কয়েন ছড়ানোর কারণে জনগণের মাঝে এই মুদ্রা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
সিন্ডিকেটের রাজত্বঃ
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে, কিছু অসাধু চক্র কয়েন ও ছেঁড়া নোট কম দামে কিনে ব্যাংকে জমা দিয়ে পুরো মূল্য উত্তোলন করছে। এই সিন্ডিকেট ব্যাংক কর্মকর্তার সহযোগিতায় ১০০ টাকার কয়েন ৭০–৮০ টাকায় কিনে মুনাফা করছে। এটি একপ্রকার “ছায়া মুদ্রা ব্যবসা”, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানছে।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও দায়ঃ
সরকার প্রতি বছর গড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েন ছাপে (অর্থ মন্ত্রণালয়, ২০২৩), অথচ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সরকারি সেবায় কয়েন গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়, গণসচেতনতাও নেই, নেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে সরকারি ব্যয় গচ্ছিত রয়ে যায় অলস মুদ্রারূপে।
সমাধানের উপায় কী?
নীতিগত সিদ্ধান্তঃ
সব ব্যাংকে কয়েন গণনার ডিজিটাল যন্ত্র স্থাপন।
মাসে একবার ‘কয়েন জমা ক্যাম্পেইন।’
কয়েন গ্রহণে বাধ্যতামূলক কেন্দ্রীয় সার্কুলার।
ডিজিটাল সমাধানঃ
বিকাশ/নগদ/রকেট-এ “কয়েন ব্যালান্স” যুক্ত করা।
QR/বিল পেমেন্টে খুচরা পয়সা যুক্তকরণ।
আইন প্রয়োগ ও প্রচারঃ
কয়েন প্রত্যাখ্যান করলেই জরিমানা।
টিভি, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে প্রচার।
স্মার্ট কয়েন চালুঃ
QR/NFC সম্বলিত আধুনিক ডিজিটাল কয়েন।
হালকা, প্লাস্টিক-ধাতব মিশ্রণযুক্ত আন্তর্জাতিক মানের কয়েন।
দেশে কয়েন আছে, কিন্তু ব্যবহার নেই—এ যেন একটি আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতিচ্ছবি। ৩৫৫০ কোটি টাকার ধাতব মুদ্রা যেখানে ব্যাংক, বাসা বা সিন্ডিকেটের গুদামে পড়ে থাকে, সেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা স্পষ্ট।
এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে কয়েন একদিন বাংলাদেশের অর্থনীতির চরম উপহাস হয়ে থাকবে—আইনি অথচ অচল এক প্রতীক হিসেবে।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাদেশ ব্যাংক Annual Report 2022–2023
অর্থ মন্ত্রণালয়, সরকারি মুদ্রণ ব্যয় প্রতিবেদন, ২০২৩
ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU), মার্চ ২০২৩
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এজ (জানুয়ারি–ডিসেম্বর ২০২৩)
গবেষণা প্রতিবেদন: “The Fate of Coins in Digital Bangladesh”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ, ২০২২