মানুষের সাথে বক-ঘুঘুর বন্ধুত্ব



মহিউদ্দিন মোল্লা।।
নদীর নাম হাভাতিয়া। অবস্থান কুমিল্লার হোমনা ও তিতাস উপজেলায়। নদীটি পুরান বাতাকান্দিতে দুই উপজেলাকে ভাগ করেছে। উত্তরপাড়ে হোমনা উপজেলার মহিষমারী গ্রাম। দক্ষিণপাড়ে পুরান বাতাকান্দি। নদীর উত্তরপাড়ে একটি বাড়ি। যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সেই বাড়ির পাশে ছোট পুকুর। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঝাকড়া চুলের একজন তরুণ। তিনি মুখে বকের ডাক তুলেছেন। ডাক শুনে পুকুরের উত্তর পাড় থেকে দুইটি বক উড়ে আসে। কোনটা তার কাঁধে কোনটা হাতে বসেছে। তিনি হাতে রাখা পাত্র থেকে ছোট মাছ মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। সাদা বকের পাখার ঝাপটায় তরুণের চোখে মুখে খুশির দোল খেলে যায়। তিনি আবুল কাশেম ভুঁইয়া। ১৯৯৩সাল থেকে তিনি পাখি ও প্রাণীর প্রেমে মগ্ন। কোন পাখি ও প্রাণীকে তিনি আটকে রাখেন না। অসুস্থ পাখি ও প্রাণীকে উদ্ধার করে এনে চিকিৎসার পর তারা উড়ে চলে যায়। এই বক জোড়া দেড় মাস তার এখানে থাকে। এরকম তার এখানে ঘুঘু ও শালিকসহ নানা পাখি সেবা পায়। তিনি অসুস্থ ও অসহায় বিড়াল ও কুকুর বাড়িতে তুলে আনেন। বাড়িতে এক জোড়া খরখোশ,কবুতর ও বিড়াল রয়েছে। অনেকে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে তার বাড়িতে এসে মানুষ ও পাখির ভালোবাসা দেখেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ঘরের দক্ষিণ জানালার পাশে আম গাছ। সেখানে নির্ভয়ে ডিমে তা দিচ্ছেন মা ঘুঘু। এই প্রতিবেদকে ছবি তুলতে দেখেও সে নির্ভয়ে ছিলো। যেন ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে। বাড়িটি পাখি ও প্রাণীর জন্য হয়ে উঠেছে নিরাপদ আশ্রয়। ওই বাড়িতে আবুল কাশেম ভুইয়া,তার শিক্ষিকা স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন। সবাই পাখি ও প্রাণীর যত্ন করেন। টিনের চালা ও বেড়ার ঘর। পায়ের তলায় মাটি। তবে সেখানে সুখের অভাব নেই। তিনি পাখির যত্নের সাথে অবসরে বসে যান দোতরা বা গিটার নিয়ে। তার সুরে গাইতে থাকেন আধ্যাত্মিক যত গান।
তার ৭ম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান খাদিজা। সে জানায়, বান্ধবীরাসহ গ্রামবাসী আমাদের বাড়ির পশু পাখি দেখতে আসে। বাড়িটিকে তারা চিড়িয়াখানা বলে। বাবার সাথে আমরা পাখিদের যতœ নিই। আমাদে পাখির সাথে থাকতে ভালো লাগে।
গ্রামের বাসিন্দা তাইজ মিয়া,আবু সায়েম সরকার ও মো. সাইফ বলেন,কাশেমকে এলাকার মানুষ পাখি প্রেমী বলে ডাকেন। তার বাড়ি পাখির অভয়ারণ্য। পাখিকে ডাকলে তার কাছে চলে আসে। পাখি ও প্রাণীকে ভালোবাসা একটি ব্যতিক্রম কাজ। আমরাও পাখি ও মানুষের খুনসটি দেখতে যাই।
আবুল কাশেম ভুইয়া জানান, তিন ভাই তিন বোনকে রেখে তার বাবা মারা যান। তখন তার বয়স ১০ বছর। তার মা তাদের বুকে আগলে রেখে বড় করেছেন। ওই বছর তাদের বাড়ির পাশের মান্দার গাছ থেকে ঝড়ে একটি পাখির বাসা নিচে পড়ে যায়। পাখি কাছে এলে মুরগি তাড়া করে। সেই সময় ছানার জন্য পাখির আকুতি তার মনকে নাড়া দেয়। তিনি ছানাকে উদ্ধার করে কেঁচো এন খাইয়ে দেন। তিনি তার মা-বাবার কথা মনে করেন। মনে করেন তার পরিবারের কথা। সেই থেকে তিনি পাখি ও প্রাণীর যত্ন শুরু করেন।
তিনি বলেন,মানুষ বেইমানি করতে পারে, প্রাণী তা করে না। অনেক প্রাণী এক বছর পরে এসে তার বাড়ির পাশের গাছে থাকে। তিনি হাত বাড়ালে উড়ে হাতে বসে।
বকের গল্পের বিষয়ে বলেন, তিনি কিশোর বয়সেও বকের ছানা এনে পালন করে ছেড়ে দেন। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের হোমনা ও তিতাসের প্রতিনিধি। তিতাসে এক এলাকায় শিকারিরা বকের বাসা ভেঙ্গে ছানা নিয়ে যায়। তিনি প্রশাসনেকে জানিয়ে সেটা বন্ধ করেন। এই রকম এক অভিযানে দুইটি বকের ছানা ফেলে চলে যায় শিকারিরা। তিনি সেগুলো এনে লালন করছেন। ওরা রাতে গাছের ডালে থাকে। আশপাশের মাঠে গিয়ে খাবার খায়। তিনি ডাকলে আবার উড়ে চলে আসেন। তার কাজ অনেকটা ‘জীবে দয়া কনে যেজন সেজন সেবিছে ঈশ্বর।
তিনি বলেন,কোথাও পাখি আহত হলে এলাকাবাসী তার কাছে এনে দেন। তিনি খাওয়া ও ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। তারপর আকাশে উড়িয়ে দেন। একাবার মালিক কলাগাছ কেটে ফেলেন। পাতায় ছিলো টুনটুনির বাসা। তিনি ছানা উদ্ধার করে তাদের পোকার ডিম সুইয়ের মাথায় নিয়ে খাইয়েছেন।
কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন,পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য ও সুন্দর সমাজের জন্য পাখি ও প্রাণীর প্রতি যত্নের বিকল্প নেই। তাদের দরদ দেখানোর মানুষের সংখ্যা সমাজে নেই বলতে চলে। আবুল কাশেম ভুঁইয়া তাদের তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনি একা বড় কাজ করতে পারবেন না। টিম গঠন করে পাখি ও প্রাণীর সেবায় একটি টিম গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন।