যেভাবে মুরাদনগর নামকরণ

মমিনুল ইসলাম মোল্লা।।
কুমিল্লার একটি প্রাচীন জনপদ মুরাদনগর। থানা হিসাবে ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে দুটি থানা নিয়ে মুরাদনগর উপজেলা গঠিত। উপজেলার নামের উৎস অনুসন্ধানে জানা যায়, মুরাদনগর নামটি এসছে মুরাদ বেগ থেকে। নামকরণের ব্যাপারে ভিন্ন মতও পাওয়া যায়। মোগল স¤্রাট শাহজাহানের কনিষ্ট পুত্র মুরাদ কোন এক সময় এখানে এসেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তার নাম থেকেই হয়তো উপজেলার নাম হয়েছে। এছাড়া আরেকটি মতও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেটি হচ্ছে মীর মুরাদ আলীর নামানুসারে মুরাদনগর। তিনি ছিলেন ব্রটিশ আমলের একজন রেভেনিউ কালেক্টর। তবে কোনটির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চয়তা দেয়া না গেলেও ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে নূরনগর পরগনার মালিক মুরাদ বেগ যে সনদটি পেয়েছিলেন তা পাঠ করলে মনে হয় এই নামটিই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। ” ৭ স্বস্তি : – শ্রীল শ্রীযুক্ত মুরাদ বেগ…আনাং শ্রীকার কোন বর্গে সমাজ্ঞেয়ং —-পরং মুদকাত নূরনগর ( হাল ) মুরাদনগর ডিহি হালমৌজে সুলতানপুর ও নওয়ামুড়া অমুঙ্গল আবন্দ করাইবার পাট্টা শ্রীমধূসূধনকে পুত্র পৌত্র তার পুরুষানুক্রমে দ্রোন প্রতি শিন্কা ৪ ( চারি রুপাইয়া ) দিবা এই জমিন আবাদকর ও খানেবাড়ির ভোগস্বত্ব অজজাঙ্গুলি মুরাদনগরের দপ্তর পাইবা আমিও তোজি মাহাফিক পাইব। ইতি ১১২৩ তারিখ ১ কার্তিক ( নভেম্বর ১৭১৭ খিষ্টাব্দ ) সূত্র রাজমালা ৫৬০ পৃ ঃ
মুরাদনগরে রয়েছে বহু প্রাচীন স্থান। শুধু মুরাদনগর কেন প্রাচীন ময়নামতি-সমতট রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্রতœ নিদর্শন। কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার বাদেও কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রতœ নিদর্শন। এসব স্থান থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো কুমিল্লা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দেবিদ্ধারে গুপ্ত সম্রাজ্যের গুণিকাগ্রহর বা গূণাইঘর, বরকাতা, বিহারমন্ডল, বরুড়ার মন্দুক, চান্দিনা সদর অন্যতম। মুরাদনগরের যে কয়টি গ্রামে প্রতœতত্ত্বের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে পাহাড়পুর অন্যতম। এটি দক্ষিণ মুরাদনগরে অবস্থিত। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এ গ্রাম থেকে ১৯৭৯ সালে তিনটি তা¤্রশাসন আবিষ্কিৃত হয়। তা¤্রশাসনগুলো ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এর পাঠোদ্ধার করা যায়নি। তবে গজলক্ষী সম্বলিত সিলমোহর ও কিছু কিছু পাঠ থেকে এগুলোকে রাতবংশের তা¤্রশাসন বলে মনে করা হয়। জানা যায় , একাধিক ঢিবি থাকায় এর নাম পাহাড়পুর হয়েছে। রাত বংশ সমতটের একটি রাজবংশ। এ সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস হলো শ্রীধারণ রাতের কৈলান তাম্রশাসন। ১৯৪৫ সালের কিছু পূর্বে লেখটি কুমিল্লার প্রায় ২৭ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কৈলান (বা কৈলাইন) নামক এক গ্রামে আবিষ্কৃত হয়। সামন্ত লোকনাথের ত্রিপুরা তাম্রশাসনের প্রায় অনুরূপ এ তাম্রশাসন ১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথম দীনেশচন্দ্র সরকার ও পরবর্তী সময়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী এবং আরও অনেকে পাঠোদ্ধার করে প্রকাশ করেন।
এছাড়া দক্ষিণ মুরাদনগরের আরেকটি প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রাম বাবুটিপাড়া। কালো পাথরের তৈরি একটি সূর্য মূর্তি এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর পরিমাপ ১৩৫*৬৫ সেমি। সূর্য দেবতা দুই হাতে সনাল পদ্ম ধারণ করে স্থানক ভঙ্গিতে সপ্তরথ পাদপিঠের ওপর দন্ডায়মান। তার মস্তকের চারপাশে অলৌকিক দীপ্তি ও বক্ষে উপনীত বিদ্যমান। ডানপাশে কোষবদ্ধ তরবারি। পায়ে উঁচু বুট জুতা পরিহিত্ দেবমুতিৃর দুপাশে তার দু স্ত্রী সংগা ও ছায়া দন্ডায়মান। এছাড়াও দন্ডী ও পিঙ্গেল নামে দুজন অনুচরসহ সারথী অরূণ যথা স্থানে দাড়িয়ে রথ ( সাতবরাহ খচিত ) পরিচালনা করছে। মূর্তিটি ময়নামতি প্রতœতাত্তিক জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। মুরাদনগর সদরে পাওয়া গেছে ননী গোপাল-১ নামের একটি মূর্তি। এটি একটি পিতলের মূর্তি। এটি ময়নামতি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিমাপ ১০ সে.মে*৯ সে.মি। হামাগুড়ি ভঙ্গিমায় থাকা মূর্তিটির বাম হাত ভাঙ্গা। ডান হাতে একটি গোলাকার বস্তু ধরে আছে।
লেখক:গবেষক, সাংবাদিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, কুমিল্লা ।

inside post
আরো পড়ুন