শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ এখনো কানে বাজে

।। মহিউদ্দিন আকাশ।।
২০১৮ সালের আন্দোলনের মুখে বাতিল হওয়া কোটা পুনরায় আদালতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনায় দেশব্যাপী শুরু হয় কোটা বিরোধী আন্দোলন।  যা ধীরে ধীরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রুপ নেয়।

শিক্ষার্থীদের মিছিলে শুরু থেকেই বাধা দিলেও হামলা হয়নি তখনো। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষার্থীরা দখলে নেয় শাহবাগ।  তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নিয়ে কটুক্তি করেন ওবায়দুল কাদের।  তিনি বলেন – আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এক বক্তব্যে সারাদেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন জায়গায়-ক্যাম্পাসে কুকুরের মত ঝাপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। রক্তাক্ত হয় ছাত্র ছাত্রীরা।

inside post

এরই মাঝে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে মন্তব্য করেন।
এতে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী।  রাতেই শিক্ষার্থীরা সকল ক্যাম্পাস, রাজপথে স্লোগান দেন- তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!

সংবাদ কর্মী হিসেবে কুমিল্লার চিত্র সচক্ষে দেখেছি। শিক্ষার্থীদের ডাকা বাংলা ব্লকে ১৮ জুলাই সকাল থেকে বাধা দেয় পুলিশ,ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ।
সকল বাধা উপেক্ষা করে কৌশলে শিক্ষার্থীরা ঢাকা -চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি বিশ্বরোড ব্লক করে ফেলে।
এরই মাঝে পুলিশ র্যাব,বিজিবির সাথে শুরু হয় সংঘর্ষ।

পুলিশ র্যাব বিজিবির অস্ত্রের বিপরীতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় পড়ে থাকা ইট পাটকেল দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করে।

দীর্ঘ ৬ ঘন্টা লড়েছে শিক্ষার্থীরা। মাঠ ছেড়ে যায়নি। সর্বশেষ প্রশাসন আত্মসমর্পণ করে। তবে এর মাঝেই আহত হয়েছে ২০০ এর বেশি শিক্ষার্থী।  ইবনে তাইমিয়া স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাইম এর (নবাবপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পুত্র) চোখে গুলি লাগে। আমার ছোট ভাই ফয়সালসহ কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করি।

তবে রাতে অভিযান চালিয়ে অনেক শিক্ষার্থী গ্রেফতার করে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি জামায়াতের নেতাদেরও আটক করে।

নেট বন্ধ স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোও জিম্মি। সারাদেশে কারফিউ জারি।

মুখে মুখে চতুর্দিকে গুজব। সর্বত্র ভয় আর আতংকে দিন কাটছে মানুষের।

এর মাঝে সপ্তাহখানেক পর নেট খুলে দেওয়া হল। তবে ভিপিএন দিয়েই চালাতে হয় ফেসবুক ইউটিউব টেলিগ্রাম।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিগ্রাম জুড়ে ভেসে আসল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি,বাড্ডা, সাভার,উত্তরাসহ নানান জায়গায় তৎকালীন পুলিশের নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলে। র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করা হয়। এতে বাদ যায়নি ছাদে থাকা শিশু ও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল ছাত্রী। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সারাদেশের ছাত্র জনতা।

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন রুপ নেয় ছাত্র জনতার গণআন্দোলনে।

৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা।

কুমিল্লায় সকাল থেকেই সারা শহরজুড়ে তৎকালীন এমপি বাহারের নির্দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে।

”অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়,জ্বলে পুড়ে ছারখার তবুও মাথা নোয়াবার নয়” ।

আওয়ামী লীগের অস্ত্র সজ্জিত ক্যাডার বাহিনীর সামনেই কুমিল্লা জিলা স্কুলের গেইট ভেঙে প্রবেশ করে ছাত্র – জনতা।

আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে জিলা স্কুলের গেইটের দু পাশেই অবস্থান নেন। তখনো প্রশাসন নিরব ভূমিকায়।

ছাত্র জনতার মিছিল চলছে। আওয়ামী লীগ অবরুদ্ধ করে রেখেছে তাদের।  তাদের উদ্ধার করতে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে জড়ো হোন শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।

মিছিল নিয়ে তারা জিলা স্কুল গেইট থেকে অবরুদ্ধদের উদ্ধার করে পুলিশ লাইনে জড়ো হোন।

হঠাৎ করেই অস্ত্র সজ্জিত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কায়দায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে।

একের পর এক গুলি আর লাঠিপেটায় দিকবিদিক ছুটতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

গুলিবিদ্ধ হোন ১১ জন শিক্ষার্থী।  আহত হয় শতাধিক।

নিরীহ ছাত্রীরা যখন দিকবিদিক ছুটতে শুরু করে। পিছন থেকে ছাত্রীদেরকে বেধরক পিটায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা।

আমোদ এর রিপোর্টার মোহাম্মদ শরীফ এবং আকাশ টিভির রিপোর্টার ফাহিম মুনতাছিম এ নৃশংসতার লাইভ করছিলেন। আওয়ামী লীগের এক নেতা (সাংবাদিকও বটে) তাদের লাইভ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। লাইভ বন্ধ না করায় শরীফ ও ফাহিমের মোবাইল ফোন মাটিতে ফেলে দেয় এবং তাদের উপর চড়াও হয়।

পুলিশ লাইনের সামনে এ ঘটনা অথচ একজন পুলিশও ব্যারাক থেকে বের হোননি। গেইটের ভিতরে প্রস্তুত হয়ে নৃশংসতা দেখছেন দর্শক হয়ে।

আমরা একটু সামনেএগিয়ে যাই ফুটেজ নিতে। কিন্তু ছাত্রীদের উপর গুলি হলে তারা আতংকিত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের চিৎকারে পা থেমে গেল।

আন্কেল বাঁচান!  বাঁচান! করে চিৎকার করছে মেয়েগুলো।  গুলির মুখে তাদের সহযোগিতা করার দুঃসাহস সেদিন করতে পারিনি।

চোখের সামনেই দেখলাম আমার ভাতিজি (নবাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাহান ভাইয়ের মেয়ে) সুমাইয়া নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌঁড়াচ্ছে।  কিন্তুু মাত্র একাদশ শ্রেণীতে পড়া এ মেয়েটিকেও ছাড় দিল না পাষন্ড আওয়ামী লীগ।

পিছন থেকে সুমাইয়ার পায়ে আঘাত করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কি অভাগা আমি! তার চাচ্চু হয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার পর্যন্ত করতে পারিনি। কারণ- তখনো আওয়ামী লীগ একদিকে গুলি করছে অন্যদিকে ইটপাটকেল ও লাঠিপেটা করছে।

ভয়ানক সে দৃশ্য রাতে ঘুমাতে দেয়নি। এর মাঝেই সার্টডাউনের ঘোষণা আসে। ৪ তারিখ সকালেই সমন্বয়কদের ফোনে আলেখারচর যাই।

সেখান গিয়ে দেখি তারা ময়নামতি। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আলেখারচর বিশ্বরোড হয়ে কোটবাড়ি বিশ্বরোডের দিকে যাচ্ছিল ছাত্র – জনতা।
এর মাঝেই কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ গুলি করতে করতে মিছিলের দিকে এগিয়ে আসে। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুলরা আমাদের চোখের সামনেই পিস্তল ভর্তি করে ফায়ার করছিলেন। সাংবাদিকদের দেখে পিস্তল তাক করে এমনভাবে যাচ্ছিলেন যেন ভিডিও করলে ফায়ার।
তবুও সাহস করে আমার রিপোর্টারকে ইশারা দিলাম সাইড থেকে ভিডিও নিতে। সে মোবাইল ফোন বের করতেই টুটুলের সাথে থাকা লোকটি এসে মোবাইল ফোন কেড়ে নিল।

আওয়ামী লীগ গুলি করতে করতে সেনানিবাসের এরিয়া পার করেও ক্ষান্ত হয়নি। তারা সেখানেও গুলি করে।

এর মাঝে সংঘবদ্ধ হয় ছাত্র – জনতা। গুলির সামনেই এগুতে থাকে। পিছু হাটতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ।  এদিকে সেনানিবাসের গেইটে একদল শিক্ষার্থী স্লোগান দেন – এ মুহূর্তে দরকার- সেনাবাহিনীর সরকার।
ছাত্র জনতার অনুরোধে সেনাবাহিনী তিনটি ট্যান্ক নিয়ে বের হয়।

ছাত্র জনতার মিছিলের সাথে সাথে আলেখারচর বিশ্বরোড আসতেই ছাত্রলীগ ছাত্র জনতার উপর গুলি ছুড়ে।  প্রতিরোধ করে সেনাবাহিনী ও ছাত্র জনতা।

পিছু হটল আওয়ামী লীগ। সন্ধা পর্যন্ত ছাত্র জনতার দখলে ছিল ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশ।

সে যে আওয়ামী লীগ পালালো। ৫ আগস্ট সারাদেশে ছাত্র জনতার বিজয় হলেও ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিজয় এনেছিল কুমিল্লাবাসী।

তবে অবাক করার বিষয় হল – এতদিন আন্দোলনের নিউজ করার কারণে যারা আমাকে আমার সহকর্মীদের হুমকি দিত। তারা এখন দেখি বিএনপি জামায়াতের কর্মসূচির তথ্য প্রচার করে।

লেখক: সাংবাদিক।

আরো পড়ুন