এক টুকরো সুন্দরবনে

 

ইলিয়াস হোসাইন।।
৩ মাঘ ১৪৩০। বাংলাদেশের প্রথম কৃষি বিশ্বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে ৮সদস্যের দল বের হলাম। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো কুমিল্লা রেল স্টেশন। প্লাটফর্মে গল্পগুজবে ব্যস্ত যাত্রীরা। কেউ মজেছে ধোঁয়া ওড়া চায়ের কাপে। আর আমরা ঐতিহ্যের শহর ময়মনসিংহ ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেসের অপেক্ষায়। আমাদের কেউ কেউ ঠিক সময় আসলেও কেউ আসতে পারেনি। ১১.৫০ট্রেনটাও আসলো ১টায়। ১ঘন্টা ২০ মিনিট দেরি।
ট্রেন আসলো। হুড়োহুড়ি করে সবাই উঠলো। সিট খুঁজতে খুঁজতে শুরুতেই শোনা গেলো দুঃসংবাদ। শরীফের মোবাইল ফোন চুরি হয়ে গেছে। খুব খারাপ লাগলো।
ঝকঝক শব্দে ট্রেন চলছে। জানালার দু’পাশে কুয়াশায় আচ্ছন্ন ধূসর মাঠ। মাঝে মাঝে দেখা মিলে আবছা হলুদের হাতছানি। আখাউড়া স্টেশনে যাত্রা বিরতি শেষে চলছে ট্রেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন অতিক্রম করে ভৈরব। আশুগঞ্জ যেতেই দেখা যায় হলুদ চাদরে ঢাকা সরিষার মাঠ। যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে সরিষা ক্ষেত আগের তুলনায় এ বছর খুব কম দেখা মিললো। কিশোরগঞ্জ,আঠাইবাড়ি,গৌরিপুর জংশন অতিক্রম করে প্রাচীন ঐতিহ্যে মোড়ানো ময়মনসিংহ প্রবেশ করলাম। সন্ধ্যা প্রায় ৭টা, প্রায় ৬ঘন্টার ট্রেন ভ্রমণ।
অটো রিকশা যোগে পৌঁছলাম জব্বারের মোড়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালেয়ের জনপ্রিয় একটি স্থান। এখানে ৫টাকার রঙ চা যেনো বুকের ভেতর মধুর স্মৃতির ধোঁয়ো উড়ায়। প্রেমিকার ঠোঁটে গল্প বুনায় ৪০টাকার ডিম খিচুড়ি। লোকসূত্রে জানা যায়, এ মোড়ের প্রথম দোকানদার জব্বারের নামে জব্বারের মোড় পরিচিতি পায়। এখনো জব্বারের দোকানটি রয়েছে। এর বুক ছিঁরে বের হয়ে গেছে সমান্তরাল রেল লাইন। দু’পাশ সবুজ শাখায় জড়ানো,পাশেই মিষ্টি রঙের শাপলার পুকুর। হাতে হাত রেখে হেঁটে যায় যুগল তরুণ-তরুণী। আবার রেল লাইনে বসে বইয়ের পাতায় মন ডুবায় বই পড়ুয়া সিরিয়াস শিক্ষার্থী। মিট মিট আলোয় বসে গানের আসর। প্রিয়তমার কাঁধে মাথা রেখে প্রেমিক খোঁজে কোটি তারকার ভিড়ে চাঁদের দেশে চাষাবাদের ঠিকানা। সন্ধ্যার পর রাত। এ সমান্তরাল লাইন যেনো প্রতিদিন এমন শত শত গল্পের কর্ণধার।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো বাংলাদেশ পরমাণু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিনা)গেস্ট হাউজে। গাঁদা ফুলের সুবাসে মুখরিত আঙ্গিনা। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শিয়ালের ডাক। কিছুক্ষণ পর পর ট্রেনের হুইসেল যেনো পুরো ক্যাস্পাসকে সজীবতায় জাগিয়ে রাখে!
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। সবাই তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত। নজরুলের শহর ত্রিশালের পথে। বাইপাস থেকে ত্রিশালের বাসে উঠলাম। এই শহর কবির শহর,জমিদারের শহর,মৎসচাষের শহর,গবেষক এবং কৃষিবিদদের শহর। বাসের জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখা যায় আপন মনে পা দুলিয়ে ভ্যানে করে যাতায়াত করছে নারী-পুরুষ। কি দারুণ দৃশ্য। বাস থেকে নেমে রিকশায়। সুতীত নদী পার করে দুখুমিয়ার ছেলেবেলার সেই দরিরামপুর হাইস্কুল, বর্তমানে নামকরণ করা হয়েছে নজরুল একাডেমি। এর পরেই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। নজরুলের মত অনেক উঁচু উঁচু ভবনের কাজ চলছে। ভেতরই দাঁড়িয়ে আছে চাদর জড়ানো সাদা কংক্রিটের প্রেমের কবি নজরুল! ক্যাম্পাসের ভেতর ছাত্র- ছাত্রীদের যাতায়াতের মাধ্যম সেই ঐতিহ্যের বাহন ভ্যান।
গেইটে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো ভ্যানে আমরাও পা ঝুলিয়ে বসলাম,কবি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। মাঝপথে
রাখালি কবির বটতলা। এর মাঝে যতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবই নজরুলকে ঘিরে। ময়মনসিংহের ত্রিশাল কবিকে শুধু হৃদয়ে নয় পুরো শহরের প্রতিষ্ঠান জুড়ে নজরুলকে ধারণ করে আছে। কবির লজিং বাড়িতে দাঁড়িয়ে চারদিকে বারান্দা বেষ্টিত চৌচালা টিন-কাঠের ঘর। বর্ষায় বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ এ শৈল্পিক ঘর কাব্য তৈরি করতো নিশ্চিত। এর সামনেই ধ্যান-মগ্নের সবুজ রঙের পুকুর। গভীর চোখে তাকালে যেনো দুখু মিয়া,বিদ্রোহী,প্রেমের কবির দু’চোখ পুকুর জলে ভেসে উঠে।
দুপুর ১টা। আমরা মুক্তাগাছার পথে। বাসের চালকের সাথে হাত-পা গুঁজে চেপে-চুপে বসে আছি। বাস চালক একটার পর একটা পুরোনো দিনের গান বাজিয়ে যাচ্ছে। রুচিশীল সঙ্গীত। বিরক্তির রস কাটানোর মতো ক্লাসিকেল সুর। বাস থেকে নেমে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছি। গোপাল পালের দু’শত বছরের প্রসিদ্ধ মন্ডার(মিষ্টি জাতীয় খাবার) দোকানের উদ্দেশ্যে। সেই সাথে পেয়ে গেলাম ১৮২০সালে নির্মিত শিব-কালী মন্দির। প্রায় দু’শ বছরের জরাজীর্ণ অতীত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
জমিদার বাড়ির গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে কারুকার্যে রচিত দৃষ্টি নন্দন বহুল স্থাপনা। কি নেই এর ভেতর:রঙ্গ মঞ্চ থেকে শুরু করে হাওয়া ভবন। তবে সবই এখন ভাঙাচোরা ইতিহাস। যা আমাদের বহু কিছু শিক্ষা দেয়। ময়মনসিংহ শহরে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়ালো। জম্পেস আড্ডায় আবারো জব্বারের মোড়। গাভীর দুধের চায়ের ফুঁয়ে ক্লান্তি দূর করা। তার ফাঁকেই সাইনবোর্ডে টাঙানো বাকৃবির ইতিহাস।
ব্রহ্মপুত্র নদের পাশেই ১২৬১একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল প্রশাসন ভবনসহ বিভিন্ন অনুষদীয় ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ২০০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, সম্প্রসারিত ভবন, ব্যায়ামাগার, স্টেডিয়াম, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জিটিআই ভবন এবং শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১৩টি হল, এবং যার মধ্যে ৪টি হল ছাত্রীদের জন্য। এছাড়াও রয়েছে ড. ওয়াজেদ মিয়া ডরমিটরি। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ টি অনুষদ এবং ৪১ টি বিভাগ রয়েছে।

শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রবেশ করলাম বোটানিক্যাল গার্ডেন। দেখতে যেনো একটুকরো সুন্দর বন। গেওয়া, সুন্দরী,হরতুকি,লোহা কাঠের সবুজ ছায়া,বাঁশঝাড়, ক্যাকটাস সংরক্ষণশালাসহ রয়েছে বিলুপ্ত হওয়া বহুপ্রজাতির প্রাচীন বৃক্ষ। সাথে পেলাম হারাতে বসা আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণের দৃশ্য। পাশেই ঢালু রাস্তা নেমেছে ব্রহ্মপুত্রের নদীর কোল ঘেঁষে!
ব্রহ্মপুত্রের কোলে আমরা ভাসছি। কারো গলায় গান,কারো ঠোঁটে হাসি,উল্লাস। মাঝ নদীতে ভাসছে পাতি হাঁসের দল। নদীর পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর রাখালের হাসি। মাচায় ঝুলছে লাউ। মাছরাঙ্গার অপেক্ষা। শূন্য নৌকায় জোড়া শালিকের বিশ্রাম, যা হৃদয় হরণ করে খুব সহজে।
নদী পাড়াপাড়ে প্রতিজন মাঝিকে ১০টাকা দিতে হয়। নদীর পাশেই মেয়েদের রোকেয়া হল।


দুপুর গড়াতেই টিএসসিতে সবাই খাবারের থালায় হাজির। ৬০টাকায় ১টুকরা মুরগির মাংস আর পোলাওয়ের চালের ভাত। যা এখানকার শিক্ষার্থীদের নিকট বিশেষ খাবার বলে পরিচিত।
খাবার খেয়ে তড়িঘড়ি করে সবাই চলে গেলো দৃষ্টি নন্দন ১গম্বুজ মসজিদে। সেখান থেকে অটোযোগে এশিয়ার বিখ্যাত জার্মপ্লাজম তথা ফলজ সংরক্ষণ। ভেতরে ঢুকতেই সারি সারি আম,জাম,আমড়া,বেলসহ হরেক রকম ফলজবৃক্ষ। মাঝখানে কুঁড়েঘর চারদিকে শাপলার হ্রদ। ব্রিজে উঠে সবার হাত উঁচিয়ে ফটোসেশন। বের হতেই সামনে বহু জায়গা জুড়ে শিক্ষার্থীদের চাষ করা সরিষা ক্ষেত। চারিদিকে হলুদ উৎসব। হলুদ যেন ঠিক রমনীর চোখ জোড়ার মতোই নমনীয় সুন্দর। রাস্তার দু’পাশে যতোদূর চোখ যায় সারি সারি আমবৃক্ষের বেয়ে পড়া রূপ মুগ্ধ করে। দুপুরের আলো নামতেই এখানে জমা হয় শাড়ি পরা রমনীদের উপচে পড়া ভিড়।
জয়নুল গ্যালারি দেখার সুযোগ হলোনা,তার সাথে ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে গড়ে উঠা ময়নাদ্বীপও!

আমরা শশীলজের পথে। বাকৃবি থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা করে অটো ভাড়া। শশীলজে প্রবেশ করতেই প্রাচীন বৃক্ষের পাতা ঝরা শাখা আর ফুলবাগানের সৌরভ সবাইকে দোলা দেয়। এ লজ মুক্তাগাছা জমিদারের দত্তক ছেলের বাস ভবন। জমিদার বাড়ির মতই কারুকার্যে গড়া শশীলজ। বর্তমানে তা জমিদারদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রসহ বহুল সংরক্ষিত অমূল্য জিনিসে সাজিয়ে রাখা জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত। এছাড়াও এর ভেতরের অংশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুকুর ঘাট।
রাত ৯.৪০মিনিট। বিজয় এক্সপ্রেসের হুইসেল বাজলো। ঠান্ডায় জানালার বাইরে মাথা বের করে দিয়ে আরেকবার এ শহর দেখে নিচ্ছি। জব্বারের মোড়,রেললাইনের সমান্তরাল প্রেম,শাপলা পুকুর,বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস,শশীলজের বিলাস জীবন,জমিদারের জমিদারিত্ব যেনো এ ট্রেনের সময়ের মতো:সময় ফুরালেই নির্দিষ্টি স্টেশনে সযত্নে নামিয়ে দেবে!