বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কেন্দ্রে গণমানুষ

।। ড. মো. মেহেদী হাসান ।।
‘আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন‘ — এ ভাষায় যিনি বিনয় প্রকাশ করেন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ভাষার ভেতরে আমরা পেয়ে যাই বাংলার ব-দ্বীপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে ধ্বনি-শব্দ-বাক্য-ভাষায় যে সরলতা আর মায়ার জাল বিছানো আছে তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাশীলতায়ও এ বৈশিষ্ট্য আমরা খুঁজে পাই। মাত্র ৫৫ বছরের একটা জীবন তাঁর, কর্মকুশলতা দিয়ে তিনি একটা জাতিকে মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক কারণে তিনি ব্যাপক চিন্তাশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন নি। আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি যখন তাঁর চিন্তাশীলতার পরিচয় দিতে শুরু করবেন তখন ঘাতকের নির্মম আঘাতে সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, তিনি প্রধানত তাঁর স্ত্রীর পরামর্শে আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। প্রায় ২৪ বছরের পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনকালে ১৫ বছরের বেশি তিনি জেলে কাটিয়েছেন এবং মহিয়সী এ নারীর পরামর্শে নিয়মিত জেলজীবনের অভিজ্ঞতার বিবরণে কিছু কিছু চিন্তাশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন। আমাদের বর্তমান আলোচনা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২) এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭) এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০)-এর ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত। এ ছাড়াও আমরা তাঁর নানা সময়ের বক্তৃতা বিশেষ করে নানা সময়ে সংসদে প্রদত্ত বক্তৃতা এতে ব্যবহার করেছি।
দুই.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু বলছেন:
পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা পশ্চিম পাকিস্তান সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে।
এ ভাবনায় আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে তাঁর স্বপ্নের দেশটা দেখতে পাচ্ছি। সেটার ‘স্বাধীন সার্বভৌম’ সত্তা সম্পর্কে তিনি ভুলছেন না। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর এ স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি। যে স্বপ্ন তাঁর বাস্তব হয় নি সে স্বপ্ন সম্পর্কে তিনি বলছেন:
কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা ও তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার তীব্র প্রতিবাদ করলেন । বর্ধমান ডিভিশন আমরা নাও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না?
এখানে বলে রাখা ভালো, আসামের যে সিলেট আমরা পেয়েছি, সেটাও গণভোটের মাধ্যমে। তার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে সিলেট চষে বেড়াতে হয়েছে। বলা যায়, তরুণ মুজিবের রাজনৈতিক অর্জন সিলেট। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে যে পাকিস্তান এলো সেটা জিন্নাহরই ভাষায় ‘পোকায় খাওয়া’। তবুও দেশভাগের পর যে দেশ পেলেন সে দেশকে নিয়েই তিনি ভেবেছেন। সে দেশের রূপটা যেন অসাম্প্রদায়িক হয়, একটা আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়, সে দিকে নজর দিয়েছেন। আমরা দুটি উদাহরণ দেবো। এক. তাঁর স্বদেশের নামকরণ বিষয়ে। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ-পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন:
মহোদয়, আপনি দেখবেন যে ‘পূর্ব বাংলা’ নামের বদলে তারা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বসাতে চায়। আমরা কতবার দাবি জানিয়েছি যে, এটা হবে বাংলা। বাংলার একটা ইতিহাস আছে, এর নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। জনগণের সঙ্গে আলোচনা করেই কেবল এটা বদলানো যায়। যদি আপনারা এটা পরিবর্তন করতে চান তাহলে বাংলায় ফিরে যাবো এবং মানুষকে বলবো তারা এটা গ্রহণ করবে কি না?
এ বক্তব্যের কেন্দ্রে জনগণ অবস্থান করছে। এটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভাবনার শক্তি, যার মৌল প্রেরণা জনগণের মতে গভীর আস্থা। দুই. আমরা আরেকটা উদাহরণ দেবো পূর্ব-পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার বক্তব্য থেকে। এখানে তিনি সংবিধান ও নির্বাচনে মানুষের অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন। মানুষকে বিচার করতে হবে তার জন্ম পরিচয়ে, ধর্মের পরিচয়ে নয়। সে বিষয়টি বুঝাতে তিনি ১৯৫৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় বলেছিলেন:
দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এরপরও যদি আজকে আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটা হিন্দু আর একটা মুসলমান, তাহলে একটা প্রভোকেশন দেয়া হয়। আজ যদি পূর্ব-বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে আমাদের আলাদা জায়গা অর্থাৎ একটা হিন্দু স্টেট দিতে হবে, তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, পাকিস্তানের ইনসাফের খাতিরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাতিরে আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করবো তাঁরা যেন এই সেপারেট ইলেকটরেটের প্রস্তাব উইথড্র করেন।
এই যে গণমানুষের প্রতি তাঁর সুগভীর আস্থা এ আস্থা থেকেই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের জন্ম। আমরা দেখছি, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘তে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগের কারণ হিসেবে বলছেন:
আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নেই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে…বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।
আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে পরিণত করছেন, সে আওয়ামী লীগকে ষাটের দশকে পুনর্জীবিত করতে সোহরাওয়ার্দীকে চাপ দিচ্ছেন। বৈরী পরিবেশে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি সম্পর্কে আইয়ুবের সামরিক শাসনের সময়ে একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এপিপির চিপ রিপোর্টার আমানউল্লাহ:
শেখ মুজিবের মধ্যে একটা ডেয়ার ডেভিল ভাব ছিলো, যা অন্য কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে ছিলো না। একবার মুসলিম লীগের রাগিব আহসান একদল গু-া নিয়ে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের মিটিংএ হামলা করে। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। উপস্থিত সবাই যে যে দিকে পারে ছুটে পালায়। ওই সময় কারোরই থাকার কথা নয়। অবাক হয়ে দেখলাম, ডায়াসের ওপর শুধু একজন দাঁডিয়ে আছে, শেখ মুজিব। হি ওয়াজ কারেজিয়াস।
মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তিতে তাঁর ছিলো অগাধ আস্থা। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়, জনগণের জন্যই রাষ্ট্র তাই জনগণই তার ভাগ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ১৩ই জুলাই ১৯৬৬ সালের ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখছেন:
আমরা দুইটা রাষ্ট্র পাশাপাশি। অত্যাচার ও গুলি করতে কেহ কাহারও চেয়ে কম নয়। গুলি করে গ্রেফতার করে সমস্যার সমাধান হবে না। ভারতের উচিৎ ছিলো গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেওয়া। তখন পাকিস্তান ও ভারত সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় না করে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারত। দুই দেশের জনগণ উপকৃত হত।
শেখ মুজিবুর রহমানের এ উক্তির তাৎপর্যে অনেক গভীর। দুদেশেরই শাসক শ্রেণি ও যুদ্ধবাদী গোষ্ঠী পারস্পরিক হিংসা ও ঘৃণা জিইয়ে রেখে সামরিক শক্তিকে প্রবল করে তুলতে চায়। এর ফলে বিপুল যে ব্যয় হয় তা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র-চিন্তায় সামরিক ব্যয়ের অপচয়ের দিকটি এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
৫ই ডিসেম্বর ১৯৬৯ তাঁর প্রিয় নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসের আলোচনাসভায় তিনি প্রথম দেশের নাম রাখলেন এভাবে: ‘একসময় দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমি ঘোষণা করিতেছি. আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’”।
তিন.
১৯৭২ সালে রেসকোর্সের ময়দানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন:
সকলে জেনে রাখুন বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্দ্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
এর সঙ্গে পরে যুক্ত করেন জাতীয়তাবাদ। এ জাতীয়তাবাদ তাঁর রাজনীতির প্রধান শক্তি ছিলো। সংবিধানের এ চারটি মূলনীতি তিনি কেন গ্রহণ করেছিলেন? আমাদের মনে হয়েছে এ চিন্তাশীলতা তিনি অর্জন করেছেন অভিজ্ঞতা থেকে। এটা তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতার সারাৎসার। নিজের রাজনৈতিক জীবন থেকেই তিনি শিখেছেন তাঁর রাষ্ট্রের মূলভিত্তি কী হবে তা। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তাঁর সর্বব্যাপী মমত্বের দিকটি ফুটে উঠেছে এভাবে:
আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম।…আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখন জমিদার, তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।
চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এ বইতেও সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ লক্ষ করি। তাই নয়াচীনের অনেক উদ্যোগ তিনি প্রশংসা করেন। কিন্তু তাঁর আরাধ্য গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে তিনি চীন সরকারের সমালোচনা করতে পিছপা হচ্ছেন না। তিনি বলছেন, ‘নয়াচীনের অনেক কিছুই আমার ভালো লেগেছিল এ কথা সত্য। কিন্তু নয়াচীন সরকার কম্যুনিস্ট মতবাদ ছাড়া অন্য কোনো মতবাদের লোককে রাজনীতি করতে দেয় না।’ তাই নয়াচীনে মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা না পাওয়ার কথাও বলছেন। তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রবল জোর দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, “ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।” তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রে যে মানুষ আছে, এদের সামগ্রিক বিকাশ ছিলো তাঁর আরাধ্য।

লেখক: গবেষক,শিক্ষাবিদ।