রোড নম্বর বত্রিশ বাড়ি নম্বর ছয়শত সাতাত্তর

।। মনোয়ার হোসেন রতন ।।
আমাদের একটা ছোট্ট ঠিকানা রোড নং-৩২, বাড়ি নং- ৬৭৭, সারা বিশ্বের মানুষ চিনতো নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের এক কন্ঠস্বর, বিশাল আকৃতির সিংহ প্রকৃতির, মহান হৃদয়ের এক মানবীয় গুনের মহান পুরুষ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকতেন এ বাড়িতে। এ বাড়িতেই আমাদের স্বপ্ন যাত্রা এবং স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাস রচিত হয়েছিলো। তাঁকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আমরা পথ হারা পথিক, নীড় হারা পাখির মতো হয়ে পড়লাম। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বিশ্বাস ঘাতকতার নগ্ম ইতিহাস আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে। যে বিভক্তি ও বিভাজনের দেয়াল রেখা বিশ্বাস ঘাতকরা তৈরি করে দিয়েছে। আগ্মেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বের হওয়া হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতির পিতাকে আমরা স্মরণ করবো, তাঁর আদর্শ ধারণ করে, বিভক্তি ও বিভাজনের প্রাচীর ভাঙ্গবো, স্যালুট দিবো মুজিব কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যিনি বিচার কাজ সম্পূর্ণ করে অনেককেই ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়েছেন। আর শত ধিক্কার দিবো তাদের যারা প্রত্যক্ষ ও পরক্ষোভাবে এ ঘৃণ্য হত্যাকান্ডোর সাথে জড়িত ছিলো।
যারা এ জঘন্য হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিলো, সরাসরি এবং নেপথ্যে ছিলেন, তারা কারা? তারাতো ছিলেন, তাঁর খুবই কাছের, বীর মুক্তিযোদ্ধা! এখন হয়তো বলা হবে পথভ্রষ্ট! পদ-পদবী ক্ষমতার মোহ কত নীচে নামাতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল। তাঁর হত্যাকান্ডের সাথে যারা প্রত্যক্ষ-পরক্ষো এবং মৌন ভাবে জড়িত ছিলেন তারা সকলেই ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য, সহযোদ্ধা, পুত্রসম সন্তানেরা, যাদের যাতায়াত ছিলো ৬৭৭ নং বাড়িতে সময়ে-অসময়ে, যাদের অনেকেই বেগম মুজিবকে “মা” বলে ডাকতেন, বাসায় যখন যা ছিলো তা দিয়েই তিনি খাওয়া-দাওয়া করাতেন, তাদের কত ভালোবাসার, স্নেহের পরশ বুলাতেন। অথচ আমরা কত ভয়ংকর লোমহর্ষক। বাংলার একখন্ড, অখন্ড আকাশ, মাটি, মানচিত্র আর ভূ-খন্ড স্পর্শ করবার সাহস যে পাকিস্তানীরা দেখাতে পারলো না। আমরা তাঁর হৃদয় বক্ষে ১৮টি বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলাম! বাংলার হৃদয় থেকে স্বপ্ন গুলো চলে গেল দূর আকাশে।অত্যন্ত আশ্চর্য এবং জঘন্য বিষয় সেনাবাহিনীর দু’ জন অফিসার মেজর ফারুক, মেজর রশিদ ১৮টি কামান, ২৮টি ট্যাংক ৭০০-৯০০ সৈনিক নিয়ে “রাত্রিকালীন ট্রেনিং” এর নামে বের হলেন, তাদের সাথে যোগ দিলেন বহিষ্কৃত বেশ ক’জন সেনা কর্মকর্তা। বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, আদর্শহীন এক যাত্রার পদধ্বনি। বড় বড় পদ-পদবীর অফিসার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, গোয়েন্দা বিভাগ, ডিজিএফআই, তিন বাহিনী প্রধান, রক্ষীবাহিনী, মুজিব বাহিনী, পুলিশ, বিডিআরসহ আরো আরো অনেকেই কেউ জানতে পারলো না? নাকি নীরবতার মধ্য দিয়ে মৌন সমর্থন ব্যক্ত করলেন! আগামী দিনে, নতুন প্রজন্ম সবই জানতে পারবেন আরো কারা নেপথ্যে মুখোশধারীরা ছিলেন। কি অদ্ভুত এক বিচিত্র চরিত্র নটরাজদের, অসভ্যতার কি নগ্ন চিত্র।
মেজর ফারুক ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ২৮টি ট্যাংক, ৩৫০জন সৈন্য নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুুত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে, ভীত সন্ত্রস্ত কর্নেল হাসান রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন নি। এখানে উল্লেখ্য যে, ঐ সময় ফারুকের ট্যাংকে কোন গোলা বারুদ ছিলো না। পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ যার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘কে ফোস’ গঠিত হয়েছিলো, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর বিশ^স্থ। অথচ তিনিই জয়দেবপুর ডিপোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, গোলা সরবরাহের জন্য, কি আশ্চর্য নায়ক থেকে পরিনত হতে চলেছেন খল নায়কে। ফারুক ছিলেন খালেদ মোশারফের ভাগিনা। ফারুক ছিলেন তিন দিনের মুক্তিযোদ্ধা। ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত লেঃ কর্নেল মোমেন, ফারুকের বস। তিনি সেই সময় ছুটিতে ছিলেন! চিন্তার বিষয় আরো আছে। ১৫ আগষ্ট, ১৯৮৩ এবং ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ স্যাটার ডে পোস্টে ফারুক এবং রশীদ যে চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে অনেক কিছুই স্পষ্ট করে বলেছেন, যেমন: “খালেদ মোশাররফ ছিলেন ১৫ আগষ্টের বিপ্লবী পদক্ষেপের অন্যতম জোরালো সমর্থক ও পৃষ্ট পোষাক……..”। অন্যান্য বিষয় এবং খল নায়কদের সর্ম্পকে জানা যাবে, ১৯৭৬ সালের আগষ্টের ১ম সপ্তাহে লন্ডন টেলিভিশনে ফারুক, রশীদ সাংবাদিক এ্যান্থনীম্যাস্কার্নহাস কে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বলেছেন অনেক না জানা কথা, তথ্য এবং চরিত্র সর্ম্পকে..। যেমন: জেনারেল জিয়াকে মুজিবের স্থলাভিষিক্ত করার বিষয়টি, অন্যান্য আরো বিষয়…। আরো বড় পদ-পদবীর আকাঙ্খা থেকে জন্ম নেয়া তিন নভেম্বরের দিকে তাকালেই চলে আসবে ইতিহাসের আরেক ঘটনা বহুল ৭ নভেম্বর এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ।
মেজর রশীদ ছিলেন মূলত: লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন যাত্রা পথের রাজনৈতিক সমন্বয় সাধক। খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে অন্যান্য সেনাকর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে পূর্ব থেকেই আলাপ আলোচনা চালিয়ে গেছেন। টু ফিল্ড আটিলারী রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন রশীদ, তার বস ছিলেন কর্নেল শাফায়ত জামিল। কর্নেল শাফায়াত জামিলের স্টাফ অফিসার ছিলেন মেজর হাফিজ। মেজর রশীদ ১৮টি কামান এবং ১২ ট্রাক সৈন্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এবং রক্ষী বাহিনীর দিকে অস্ত্র এবং গোলা বারুদ নিয়ে প্রস্তুুত থাকলেন। অন্য কোন দিক থেকে আক্রমণ হলে বা প্রতি আক্রমণের মুখে পড়লে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার জন্য। কিন্তুু না, কোন আক্রমণের, প্রতি আক্রমণের মধ্যে তাকে পড়তে হয় নি। তিনি ছিলেন ফারুকের ভায়রা। খন্দকার মোশতাক ছিলেন তার পাশের বাড়ির মানুষ। বঙ্গবন্ধু হত্যা হবার পর রশীদ প্রথমেই ছুটে যান শাফায়াত জামিলের বাসার তাকে গিয়ে বলেন, Sir, We have done the job. Sheikh is killed. এ বিচিত্র বর্ণচোরা স্বভাবের মানুষটি পরবর্তীতে ফারুক-রশীদ থেকে বা নতুন সরকার থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবী না পেয়ে, আবার নতুন করে জোটবদ্ধ হন খালেদ মোশারফের সাথে পরবর্তীতে আমরা দেখবো খল নায়কের নতুন অভিনয়, নতুন এক মঞ্চে!
মেজর মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমনের এক অপবিত্র দায়িত্বে ছিলেন, তার সাথে এসে যোগ দেন মেজর নুর, এক সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর এডমিন ছিলেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের স্টাফ অফিসারও ছিলেন। এরপর আসেন মেজর হুদা, মেজর পাশা। বঙ্গবন্ধু পুুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেন অথচ কেউ ফোন ধরলেন না! মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোনে বলেছিলেন, জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসো আর্মির লোকেরা আমার বাসায় আক্রমণ করেছে, শফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো……..। জেনারেল শফিউল্লাহকে বঙ্গবন্ধু নিজে ফোন করে বলেছেন, আমার বাসায় তোমার ফোর্স এ্যাটাক করেছে, কামালকে হয়তো মেরেই ফেলেছে, তুমি তাড়া-তাড়ি ফোর্স পাঠাও…। অথচ কি অবাক বিস্ময়ের, হতবাক হতভম্ব হবার আশ্চর্য এক বিষয় সেনাপ্রধান জাতির পিতাকে রক্ষা করবার জন্য একজন সৈন্যও পাঠাতে পারলেন না। যিনি কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময় “এস ফোর্সের” মহানায়ক ছিলেন। সেনাপ্রধান হিসাবে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ৭৫ এর মে মাসে বঙ্গবন্ধু আরো ৩ বছরের জন্য তার মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেকটা অপাত্রে ভালোবাসা দান করবার মতোই হলো বিষয়টি। যে খুনি চক্রের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেন নি সেই খুনিরা তাকে ২৪ আগষ্ট ৭৫ সালে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেন, তার স্থলে সেনাপ্রধান করা হয় মুক্তিযুদ্ধের “জেড ফোর্সের” জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। আশ্চর্য এক রহস্যের আবর্তে বাংলাদেশ। ঘটনা প্রবাহ চারিত্রিক বিশ্লেষণ সব কিছু-ই এলোমেলো। তার সর্ম্পকে আরো জানা যাবে ৩ এবং ৭ নভেম্বর ৭৫ সালের ঘটনা প্রবাহের মধ্যে। এখানে উল্লেখ্য যে, কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঠিকই বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি চলেই এসেছিলেন কিন্তু খুনীরা তাঁর কপালে গুলিবিদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করলেন। এরপরও বলা যায় কর্নেল জামিলের কপালে রাজ তিলক পড়েছিলো। তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে এসেছিলেন। অন্যদিকে জেনারেল শফিউল্লাহ ১৫ থেকে ১৭ আগষ্ট ৭৫ সালে সু-কৌশলে খুনী ফারুক, রশীদ, মোশতাক সরকারের সঙ্গে বঙ্গভবনে ছিলেন! কি নির্মম, কি পৈশাচিক, কি বর্বর একটা জাতি আমরা। খুনি চক্র হত্যায় মেতে উঠলেন, শেখ কামাল, একজন পুলিশ অফিসার, বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, শেখ জামাল, রোজি জামাল, সুলতানা কামাল, ছোট্ট রাসেল, শেখ নাসের। অহংকার করবার মতো গর্ব করবার মতো, যা কিছু ছিলো আমাদের অর্জন, তাঁর সবই ভূলুন্ঠিত হলো। এ কলঙ্কের দায় শুধু খুনিদের নয়, গোটা জাতিকেই নিতে হবে এ দায়ভার। বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্ত এসে স্পর্শ করলো বাংলার মাটি, রক্ত ভেজা মাটি লাগলো মানচিত্রে, সেই তাজা রক্তের দাগ, রক্ত মাখা মাটি থেকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। সেই দাগের পদ চিহ্ন নিয়ে জাতিকে পথ চলতে হবে।
মেজর ডালিম এক প্লাটুন ল্যান্সার সৈন্য নিয়ে আক্রমন করলেন শেখ সেরনিয়াবাতের বাসায়, হত্যা করলেন, শেখ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর স্ত্রী, পুত্রবধু, পাঁচ বছরের নাতি, দুই নাতনী, তাঁর ছোট্ট ছেলে, ভাতিজা, আয়া, কাজের ছেলে, চারজন অতিথিসহ সবাইকে। তাঁর বড় ছেলে হাসনাত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। অথচ কি বিস্ময়ের বিষয় একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ডালিম, যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন। তিনিই রেডিওতে ঘোষণা দিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়টি।
রিসালদার মোসলেম উদ্দিন আক্রমন করলেন শেখ মনির বাসায়। হত্যা করলে, শেখ মনি এবং তাঁর অন্ত:স্বত্তা স্ত্রীকে। মেজর ফারুকের বিশ^স্থ রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশীদের নির্দেশে জেলের মধ্যে হত্যা করেন তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে ৩ নভেম্বর ৭৫ সালে। ঘটনা প্রবাহ থেমে নেই।
মেজর শাহরিয়ার রেডিও স্টেশন, বিশ^বিদ্যালয়, নিউ মার্কেট এবং বিডিআর আক্রমন মোকাবেলা করবার জন্য দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তুুত। কিন্তু না, এখানেও কোন প্রতি আক্রমন গড়ে উঠলো না।
সবশেষ। এবার নাট্যমঞ্চে আরো কিছু নটরাজদের কর্মকান্ড, গতি বিধি লক্ষ্য করবার মতো অবিশ্বাস্য বিষয় রয়ে গেল। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার বারো ঘন্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভা, প্রশাসন দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহম্মদ, তার সেক্রেটারি মাহাবুবুল আলম চাষী, ডিফেন্স উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী, চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, সেনাবাহিনীর নতুন চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ১৬ অক্টোবর বিমান বাহিনী প্রধান এ.কে. খন্দকার কে সরিয়ে জার্মানী থেকে এম.জি. তোয়াবকে ডেকে এনে এয়ার চীফ বানানো হয়। ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় সফদারকে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার ক’জন বাদে সবাই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী সভায় স্থান করে নেন। নতুন রাষ্ট্রপতির সহযোগিতায় কাগজ-পত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। মাওলানা ভাসানী নতুন সরকারকে উষ্ণ অভিনন্দন পাঠিয়েছেন। ৮৩ দিনের শাসন আমল। অল্প ক’দিন পরেই শুরু হবে রাজনৈতিক গতি প্রকৃতির নতুন এক র্ঘূণি।
মনে প্রশ্ন জাগে, মেজর ডালিম সেনা হেড কোয়ার্টার থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সেনা প্রধান শফিউল্লাহকে ধরে নিয়ে যান রেডিও স্টেশনে। অথর্ব সেনাপ্রধান কোন এ্যাকশন নিতে পারলেন না? রক্ষীবাহিনীর চীফ ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান কোথায় ছিলেন? মুজিব বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা, নৌ, বিমান বাহিনী কেউ-ই এগিয়ে আসলেন না কেন? গোয়েন্দা অফিসার কর্নেল সালাউদ্দিন মারফত সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এবং ডিজিএফআই ব্রিগেডিয়ার রউফ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমনের সংবাদ পাওয়ার পরও কেন নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন? তিন বাহিনী প্রধান ৪৬ বিগ্রেড শাফায়াত জামিলের অফিসে বসে মিটিং করলেন কিন্তু শাফায়াত জামিল আসেন নি কেন? এরপর সকাল ১১.৩০মিঃ, ১৫ আগষ্ট, নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের প্রতি তিন বাহিনী প্রধান আনুগত্য ঘোষণা করলেন কেন? জিয়া, খালেদ, শাফায়াত রহস্যজনক ভূমিকার কারণ কি ছিলো? আরো নানা প্রশ্ন থেকে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠলো না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। নানান ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে কর্নেল লতিফের নেতৃত্বে দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাঠিয়ে তাঁর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আটকে দিলেন। অবশেষে দীর্ঘ বছর তাঁকে ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হলো। সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকরা এক হাওয়ায় কোথায় হারিয়ে গেলো! দু’এক জায়গায় প্রতিবাদের চেষ্টা হয়েছিলো কিন্তু সংগঠিত হতে পারে নি। যা অবশ্যই সাংগঠনিক দূর্বলতার নামান্তর। সংগঠিত হতে না পারার ব্যর্থতা। লেখক:বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।