চিহ্নতন্ত্রের সভ্যতায় মানবতা ও ভাষার সংকট

মনোয়ার হোসেন রতন।।
“ভাষা নিঃশেষ হলে মানুষ নিঃস্ব হয়।”
একটা সময় মানুষ শব্দে কথা বলত, এখন চিহ্নে। ভাষা আজ আর আত্মার প্রকাশ নয়, বরং এক অর্থনৈতিক এক্সেল শিটের গাণিতিক কোড। আমরা এক অভূতপূর্ব যুগে দাঁড়িয়ে আছি— যেখানে ‌®, ™, %, $, @, √ এসব চিহ্ন এখন হৃদয়, সম্পর্ক এবং সমাজের ভাষা হয়ে উঠেছে।
আজকের দিনে প্রেমের মূল্য ৳ দিয়ে পরিমাপ হয়, সম্পর্ক & দিয়ে জোড়া লাগে আর বিচ্ছেদ / দিয়ে ঘটে যায়। একটি প্রেমপত্রেও শব্দের চেয়ে চিহ্নের আধিক্য—
“ভালোবাসি” বলতে এখন ‘ব্র্যান্ডেড গিফট বক্স’ পাঠালেই চলে! তোমার খবর নেওয়া মানেই: “আছো তো? 🙂” তোমার ব্যথা বোঝানোর ভাষাও বদলে গেছে:”আজ মনটা খুব 😔…” শব্দ নেই, বোধ নেই—আছে শুধু ইমোজি আর চিহ্নের নীরব সমুদ্র।
একটা সময়ে ‘ভালোবাসা’ ছিল মানসিক প্রশান্তির আশ্রয়, আজ সেটি এক ‘সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ’। ভালোবাসা ≠ নিরাপত্তা, বন্ধুত্ব ≠ স্বস্তি, স্বজনতা, নির্ভরতা
এখন এসবের মানে দাঁড়িয়েছে:
‘কি দিতে পারো?’ ‘কি পাবে আমার থেকে?
একটি কঠিন সমীকরণ: √প্রেম ≠ ROI
π আত্মা = ক্ষতির সম্ভাবনা, সবকিছুর মানদণ্ড এখন ৳, %, #টার্গেট, @সেলস।
‘মানবতা’ শব্দটাও আজ মুনাফার ‘কন্টেন্ট’।
চ্যারিটি মানে কর ছাড়ের সুযোগ, সহানুভূতি মানে ব্র্যান্ডিং! এমনকি মায়ের কান্নাও এখন ‘ইনপুট ভ্যালু’, আর সন্তানের হাসি ‘আউটপুট মেট্রিক্স’!
এখানেই শেষ নয়, আমরা যে কমেন্ট বক্সে প্রাণ ঢেলে দিই—সেখানে শব্দ নয়, ❤️, 😢, 😮, 👍 দিয়েই প্রকাশ করি অনুভব। একটি মৃত্যুসংবাদেও “So sad 😢” লিখে দায় সারে মন, একটি প্রেমঘটিত পোস্টে “❤️🔥” হলেই প্রেমের স্বীকৃতি! এমনকি, “তুমি বেঁচে থেকো” না বলে মানুষ এখন লেখে—”Stay blessed ✨❤️” কমেন্ট বক্সে অনুভব নেই—আছে চিহ্নের গড়াগড়ি আর ডিজিটাল দয়া।
বিশ্ব যখন গণিতের মস্তিষ্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, তখন হৃদয়ের ঠাঁই কোথায়?
ভাষার পরিধি এখন এতটাই সংকুচিত যে
একটি পূর্ণ সংলাপ মাত্র তিনটি চিহ্নে সীমাবদ্ধ: ❤️🙏🙂 এই তো অনুভব!
এ সংকট শুধু প্রযুক্তির নয়, এ হলো অর্থনীতিক ভাষাচিন্তার পরিণতি।
মানুষ এখন নিজেকে ‘ব্র্যান্ড” ভাবে, সম্পর্ককে “চুক্তি”, জীবনকে “প্রজেক্ট”।
শিশুদেরও শেখানো হয়: ‘স্মার্ট” হতে হলে নিজের “ভ্যালু” বাড়াও।
কিন্তু প্রশ্ন হলো-এ ভ্যালু ‘কি হৃদয়ের, না কেবলই ‘টাকার’?
সমাজ এখন এমন এক চিহ্নতান্ত্রিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে শব্দ নয়, ‍প্রতীকই অর্থ বহন করে। এ যেন এক Post-Human Semiotic Civilization, যেখানে মানুষ আর মানুষ নয়—একটি লগো, একটি ইউজারনেম, একটি অ্যালগরিদমিক প্রতিমা!
আমরা কি তবে আমাদের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে ফেলছি? আমরা কি হৃদয়ের জায়গায় এখন কেবল = বসাচ্ছি? এ প্রশ্ন গুলো আজ জরুরি, কারণ সভ্যতার এ অদৃশ্য সংকটে ভাষা শুধু হারিয়ে যাচ্ছে না—
মানুষও তার আত্মা হারিয়ে ফেলছে।
ভবিষ্যতের কবিতাগুলো কি কেবল [], <>, |, %, ™ দিয়ে লেখা হবে? যেখানে শব্দ নেই, আছে কেবল গাণিতিক শীতলতা? শেষে প্রশ্ন শুধু একটাই – এ নিঃশব্দ চিহ্নতন্ত্রের মাঝে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে হৃদয়ের ধ্বনি?
inside post
আরো পড়ুন