কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু

।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলন কুমিল্লার রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। কুমিল্লায় যাঁদের দৃপ্ত পদচারণায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানসহ পথচলাকে গৌরবান্বিত করেছেন তাঁদের অন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঘাত প্রতিঘাতময় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছুটে বেরিয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। স্বাধীনতার পর দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরও বঙ্গবন্ধুর এ ছুটে চলা থেমে থাকে নি। বঙ্গবন্ধুর এ চলার বেগে কুমিল্লার মাটিও পেয়েছে তাঁর পদস্পর্শ, কুমিল্লার জনগণ পেয়েছে তাঁর দর্শন, দলের নেতাকর্মীরা পেয়েছে তাদের প্রিয় নেতার সান্নিধ্য। কুমিল্লার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শিল্পপতি কাজী জহিরুল কাইয়ুম (প্রয়াত), সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও প্রবীণ আইনজীবী এডভোকেট আহমেদ আলী (প্রয়াত), ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদার, সাবেক গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক খোরশেদ আলম (প্রয়াত), মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সেক্টর মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজ খান (প্রয়াত), আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোঃ আবদুর রউফ (প্রয়াত), জাতীয় মহিলা সংস্থার সভাপতি ও প্রাক্তন এম এন এ প্রফেসার মমতাজ বেগম এডভোকেট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রিয় সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসান পাখী, বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর সাথে আলোচনার সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের সান্নিধ্য ও স্মৃতিচারণ কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপস্থাপন করছি।
ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লায় পদার্পণ করেন। অবশ্য তিনি তখন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি অর্জন করেননি। স্রেফ একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি নবীনগরের কৃষ্ণনগর গ্রামে আসেন। নবীনগরের এ কে রফিকুল হোসেন তাঁকে ছাত্রনেতা হিসেবে বক্তব্য দেয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে আয়োজিত জনসভায় নিয়ে আসেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জীবৎকালে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও গণপরিষদের সাবেক সদস্য আহমেদ আলী এডভোকেট বলেছিলেন, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সত্যি বলতে কী বঙ্গবন্ধুকে দেখে তখন আমারও মনঃপুত নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। পাতলা ছিপছিপে গড়নের একজন যুবক রাজনীতি সম্পর্কে আর কী-ইবা বক্তব্য রাখবে। সভায় উপস্থিত লোকজনও এ নিয়ে কানাঘুষা করছিল। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন তখন সবার ধারণা পাল্টে গেল। সে কী বক্তব্য! মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে। আর সে ফুলকির আলোয় আলোকিত গোটা জনসমাবেশ। সেই দিনের সেই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পাল্টে যায়। অনেকেই বলতে থাকেন ভবিষ্যতে এ ছাত্রনেতা একজন মহান নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান মজবুত করবেন। বাস্তবে সাধারণ মানুষের সেই আশা অপূর্ণ থাকেনি। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ছাত্রনেতাই ছিলেন না, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন তিন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদকের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।’
কুমিল্লার আমীর হোসেন ছাত্রাবস্থায় পাকিস্তান গণপরিষদের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বঙ্গ শার্দুল মেজর গণির মৃত্যুতে ওই আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রার্থী মনোনীত হন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে এ উপ-নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রফেসর মফিজুল ইসলামকে বিপুল সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তিনি নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লায় একাধিকবার এসেছেন বলে কুমিল্লার প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা বলেছেন।
কুমিল্লার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্পপতি কাজী জহিরুল কাইয়ুম- যিনি ‘বাচ্চু মিয়া’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ছিল গভীর সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘কাইয়ুম ভাই’ বলে ডাকতেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কিছুকাল আগে আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম ও বঙ্গবন্ধু এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে কাজী জহিরুল কাইয়ুম বলেন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ইস্পাহানী স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সেখানে যাতায়াত করেন। যাতায়াতের ফলে তিনি বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামীলীগ জিতলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। সামরিক হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখন কী করা যায়?’
কাজী জহিরুল কাইয়ুম বলেন, ‘আপনার তো ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শুনেছি। অবশ্য ছিল কিনা আমি জানি না। তবে একটা যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।’
ভাষাসংগ্রামী আলী তাহের মজুমদার কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর পদার্পণ সম্পর্কে বলেন, “১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আসেন। আরামবাগ হোটেলের উপর তলার একটি কক্ষে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। আমিও তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ তিনি বলেন ওঠেন, ‘আপনি সুভাষের লোক, আপনি কেন আরএসপি করেন? আপনি আওয়ামী মুসলিম লীগ করবেন।’ আমি বলি, ‘সব সময় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা লালন করে এসেছি।”
আলী তাহের মজুমদার স্বাধীনতার পর কোতয়ালী থানা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর তিনি কৃষকলীগে যোগ দেন এবং জেলা কৃষকলীগের সভাপতি ছিলেন। কৃষকলীগে যোগদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুই আমাকে জেলা কৃষকলীগের হয়ে কাজ করার জন্য বলেন। ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল কৃষকলীগ গঠনের সময় স্বর্গীয় ফণিভূষণ মজুমদারের প্রস্তাব ও শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সমর্থনে বঙ্গবন্ধু আমাকে কৃষকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করেন।’ (রাজনীতির সদর-অন্দর, পৃ. ৩৮-৩৯)
১৯৭০ সালে পার্লামেন্ট মেম্বার পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক খোরশেদ আলম।
জীবৎকালে অধ্যাপক খোরশেদ আলম বলেছিলেন, “এরপর ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সকল আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার সমর্থনে আওয়ামীলীগের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে রাজপথে লড়েছি। ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানের সময় জেলা আওয়ামীলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।’ ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই কুমিল্লায় আসেন। অভয় আশ্রমের সামনে সেই বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সেই সভায় আমি সভাপতিত্ব করি। … ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। আমাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। ১৬ আগস্ট অর্থাৎ পরদিন কুমিল্লা জেলা গভর্ণর হিসেবে আমার শপথ নেয়ার কথা ছিল।”
একসময়ের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পরবর্তীতে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক আবদুল আজিজ খানের সাথে ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের নিবিড় যোগাযোগ। এ যোগাযোগের ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আপনজন ও আওয়ামীলীগের সুখ-দুঃখের সাথী চিওড়া কাজী বাড়ির কাজী জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে। তিনিই আবদুল আজিজ খানকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও দলীয় বিভিন্ন কর্মকা-ের জন্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় যখন টাকা পাঠাতেন তখন তা বেশিরভাগই বহন করতেন আজিজ খান।
একবার কাজী জহিরুল কাইয়ুম টাকা পাঠাতে কয়েকদিন বিলম্ব হওয়ায় আজিজ খান বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা বাসার দোতলা থেকে ফ্রিজ সিড়ি কোটা দিয়ে নিচে নামিয়ে বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ অবস্থায় তিনি তাড়াতাড়ি বলেন, ‘ভাবী ফ্রিজ বিক্রি করতে হবে না। বাচ্চু মিয়া সাহেব (কাজী জহিরুল কাইয়ুম) আপনার জন্য আমার কাছে টাকা দিয়েছেন। একথা বলে তিনি কাজী জহিরুল কাইয়ুমের পাঠানো পাঁচ হাজার টাকা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে ছিলেন। এ ঘটনার কথা জীবৎকালে জানিয়েছেন আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোঃ আবদুর রউফ।
বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যের স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ রেজাউর রহমান এডভোকেট মুজিব বাহিনী বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের কমা-ার যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় মুজিব বাহিনীর ইন্ডাকশনের চার্জে ছিলেন- তিনি বলেন, “১৯৭১-র ২৫ মার্চ বিকেল ৪টায় আমি ও আবদুল কুদ্দুস মাখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি। ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘পশ্চিমারা আজই আক্রমণ করবে। তোমরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে সৈয়দ রেজাউর রহমান ও আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রথমে ইকবাল হলে যান। ওখান থেকে তারা আনুমানিক রাত ৮টা কী সোয়া ৮টায় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক এম এ রশিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরীকে সাথে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান। এরপর দীননাথ সেন রোডে তৎকালীন এমএনএ মমতাজ বেগমের বাসায় শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশে অপেক্ষা করেন। এ বাসায় অস্ত্রের জন্য তিনদিন অপেক্ষা করেন। অস্ত্রের ব্যাপারে কুমিল্লার শিদলাইয়ের এডভোকেট আমীর হোসেন শেখ ফজলুল হক মণির সাথে লিয়াজো করছিলেন।
জাতীয় মহিলা সংস্থার সভাপতি ও প্রাক্তন এমএনএ প্রফেসর মমতাজ বেগম এডভোকেট জীবৎকালে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ফাতেমা-সোহানী ভবনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৭১ সালের ১ মার্চ সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। ওই টাকা নির্বাচন অফিসে জমা দিই। এ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাতীয় সংসদে সদস্য হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলাম। প্রেস কনফারেন্সে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর আমার আব্বা এই ৩ হাজার টাকা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ টাকা ফেরত দিতে হবে না। রেখে দাও। এ টাকা অনেক কাজে লাগবে।
মমতাজ বেগম ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমএনএ ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ নির্বাচনেরও দরখাস্তের টাকা বাবত বঙ্গবন্ধু ৮শ’ টাকা আমাকে দিয়েছিলেন। বেগম মুজিবকে আমি ‘মামি’ ডাকতাম। তিনি আমাকে ¯েœহ করতেন। মনি ভাইয়ের মাকে ‘খালা’ ডাকতাম।
১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে আওয়ামী লীগ কুমিল্লা জেলা এডহক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক করা হয় আবদুর রহমান খান ও এডভোকেট আহমেদ আলীকে। এ কমিটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপ দেয়ার জন্য ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আবদুর রহমান খান সভাপতি ও এডভোকেট আহমেদ আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ওই অধিবেশনে খোন্দকার মোশতাক আহমদ, আলী আহাম্মদ খান, আলী আমজাদ খান, এ কে রফিকুল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন।
১৯৬৬ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে এডভোকেট আহমেদ আলী বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবির প্রতি সমর্থনের জন্য কুমিল্লার মাটিতে প্রথম পথসভার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি পরদিন সকালে কোতয়ালী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অলি আহাম্মদকে ডেকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু তার বাসায় আসবেন। আসার পথে কুমিল্লা শহরের প্রবেশ দ্বার চৌয়ারা বাজারে ৬ দফার পক্ষে পথসভার আয়োজন করে যেনো শ্লোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সে অনুসারে বাংলার মাটিতে কুমিল্লাতেই ৬ দফার প্রথম শ্লোগান দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু চৌয়ারাতে লোক সমাগম দেখে ও ৬ দফার পক্ষে শ্লোগান শুনে উৎসাহিত হন তথা তাঁর মনোবল বৃদ্ধি পায়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপ-সচিব এ কে এম জহিরুল হক চৌধুরী জীবৎকালে ‘বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখেছি’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, “১৯৬৩ সনের মার্চ কিংবা এপ্রিল মাস। আহমেদ আলী চাচা আমাদের জানালেন যে, বঙ্গবন্ধু (তখনও বঙ্গবন্ধু হন নাই) দুপুর ১২ টায় ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লায় আসবেন। কুমিল্লায় এসে তিনি প্রথমে টাউন হলে কর্মীসভা করবেন। আমরা যেন সদলবলে রেল স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাই। স্টেশনে যাওয়ার জন্য আজিজ খান সাহেব আমাদের জন্য একটি বাসের ব্যবস্থা করেন। আমরা ২০-২৫ জন টাউন হলে নির্ধারিত সময়ে সমবেত হলাম। আমাদের সাথে ছিলেন সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, আছমত ভাই, লতিফ ভাই, হারুন ভাই প্রমুখ। সৈয়দ নুহুর রহমান কান্দিরপাড়ের ওরিয়েন্টাল স্টুডিও এর ম্যানেজার শান্তিদার ইয়াসিকা ক্যামেরাটি সাথে নিলেন। মোস্তফা ভাইয়ের সিংহের গর্জনসম স্লোগানসহ আমাদের বাস যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছলো। ওখানে পৌঁছে দেখি মোসাদ্দেক খান (আফজল খানের চাচা), কোবাদ মিয়াসহ অনেক কর্মী সমর্থক আগে থেকে উপস্থিত রয়েছেন। আমার হাতে ছিল রঙিন কাগজের তৈরি একটি ফুলের মালা। যথাসময়ে ট্রেন এলো। আহমেদ আলী চাচাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ট্রেনের কামরায় ওঠে নেতাকে স্বাগতম জানালেন। আমরা ছাত্ররা ট্রেনের কামরার সামনে দাঁড়িয়ে। কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, সফেদ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় নেতা ট্রেন থেকে নেমে এলেন। আমি ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। নেতা আমাকে তাঁর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে প্লাটফর্মের দিকে আসতে আসতে বললেন, ‘তোর নাম কি?’ আমার নাম বললাম। পরবর্তী সময়ে তিনি কোনোদিন এ নাম ভুলেননি। এমন সময় নুহুর তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলল। সেই ছবিটি আজও আমি সংরক্ষণ করেছি।
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লায় প্রথম আসেন ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি সেদিন কুমিল্লা টাউন হলে আওয়ামী লীগের সভায় যোগদান করেন। এরপর ১৯৭০-র ১৯ এপ্রিল মুরাদনগরে টর্নেডোর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে আসেন। ১৮ এপ্রিল দিবাগত রাত ১১ টায় তিনি এডভোকেট আহমেদ আলীকে টেলিফোনে জানান, আগামীকাল অর্থাৎ ১৯ এপ্রিল দুপুর ১২ টায় এডভোকেট আহমেদ আলীর বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবেন। এরপর মুরাদনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।
এ প্রসঙ্গে এডভোকেট আহমেদ আলী বলেছিলেন, ‘টেলিফোন পাবার পর সারারাত ঘুমুতে পারিনি। সকাল বেলা দেখি সৈয়দ রেজাউর রহমান, আবদুল মালেক, আফজল খান, আবদুর রউফ ও মাইনুল হুদার নেতৃত্বে কলেজ ছাত্রীরা এসেছে রান্না করতে। দুপুরে বঙ্গবন্ধু বাসায় এসে পৌঁছলে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও অধ্যাপক খোরশেদ আলম, এডভোকেট আমীর হোসেন, রশীদ ইঞ্জিনিয়ার তাঁর সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু সকলকে ৬ দফার ভিত্তিতে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু সেদিনই কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন মোঃ আবদুর রউফ ও আফজল খান এডভোকেটকে। এর আগে আরো একটি কমিটি গঠিত হলেও তা অনেকদিন যাবত নিষ্ক্রিয় ছিল।
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ-এ ‘মুজিবের মুক্তিতে জনসভা’ শীর্ষক সংবাদ ছাপা হয়। এ প্রতিবেদনে বলা হয়:
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪ টায় কুমিল্লা টাউন হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত অভিযুক্ত আসামি শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের মুক্তি উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা ডাক সদস্য ও আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এডভোকেট আহাম্মদ আলী। সভায় নুরুল ইসলাম খান এমপি, জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ভিপি ওমর ফারুক, সদ্য কারামুক্ত জনাব ফয়জুল্লাহ, জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী আবদুল আউয়াল, এডভোকেট আমীর হেসেন, ছাত্রনেতা আঃ রউফ, আবু আক্তার, জি এস মোঃ মাসুদ, সদ্য কারামুক্ত বিষ্ণু চ্যাটার্জি ও শিব নারায়ণ দাস প্রমুখ ব্যক্তিগণ।
সভাপতি তাঁর ভাষণে জোর দাবি জানান যে উক্ত মামলার আসামিদের জবানীতে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের যে করুণ কাহিনী প্রকাশ করা হয় সেই অত্যাচারের সহিত জামিনের জন্য উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি আরো দাবি করেন যে গণআন্দোলন কালে নিহত ড. সামছুজ্জোহা, জনৈক সার্কেল আফিসার ও চেয়ারম্যানের পরিবারকে যেরূপ ক্ষতিপূরণ দেয়া হইয়াছে, অনুরূপ ক্ষতিপুরণ অন্যান্য প্রত্যেকটি নিহত ব্যক্তির পরিবারকে যেন দেওয়া হয়।
একই পত্রিকায় ‘মুজিবসহ সকল বন্দীর মুক্তিলাভ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়ও ছাপা হয়।
১৯৬৯ সালের ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী অঞ্চল সফরে যান। সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনতা তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। কুমিল্লার চান্দিনা, ময়নামতি, জাফরগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়। খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমেদ, আহামেদ আলী, আবদুর রউফ প্রমুখ তখন উপস্থিত ছিলেন।
সাপ্তাহিক আমোদ-এর সংবাদ ও ‘মুক্তিযুদ্ধে সংবাদপত্র: আমোদ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭০-র নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৭টি জেলায় ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফর কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৭ জানুয়ারি কুমিল্লা টাউন হলে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহাম্মদ ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভার এক পর্যায়ে মানপত্র পাঠ করেন মোঃ আবদুর রউফ। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ আজও কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে গেঁথে আছে। প্রাণস্পর্শী ওই ভাষণের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বান।
মোঃ আবদুর রউফ বলেন, ১৯৬৯ সনের ২১ জানুয়ারি জনসমুদ্রে পরিণত হয় কুমিল্লা টাউন হল মাঠ ও আশেপাশের এলাকা। জনসভা শুরুর আগে সভামঞ্চে উপবেশন করে বঙ্গবন্ধু আমাকে ও রুস্তমকে বললেন, ‘বক্তৃতার সময়ে তোরা আমার দু পাশে থাকিস’। এরপর বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে কিভাবে শোষণ করা হচ্ছে, কিভাবে আমাদের অঞ্চলের সম্পদ-টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হচ্ছে, বারবার কেন্দ্রীয় রাজধানী পরিবর্তন ও কেন্দ্রীয়ভাবে উন্নয়নের নামে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা খরচ অথচ পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না করা, পাক-ভারত সংঘর্ষের সময় পূর্ব-পাকিস্তান অরক্ষিত অসহায় অবস্থার উল্লেখ করে বলেন, ‘৬ দফার ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকার তথা স্বায়ত্বশাসন ভিন্ন বাঙালি বাঁচতে পারে না। অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু একথা সত্য বাঙালির মুক্তির সনদ এই ৬ দফা। জনগণ ভোটের মাধ্যমে স্বায়ত্বশাসন আদায় করে নেবেই।’
বঙ্গবন্ধু আসলেই কর্মীবৎসল ছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আসেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে বিরাট আয়োজন। চারদিকে সাজ সাজরব তাঁকে বরণ করার জন্য। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের সদস্যদের প্লাটুন বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই টাউন হলে কুচকাওয়াজের মহড়া দিই। সার্কিট হাউসের বারান্দার সামনের পশ্চিম কোণায় মাঠে কুচকাওয়াজের সালাম নেয়ার মঞ্চ তৈরি করা হয়। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সেকি প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা, বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখতে পারবে। সালাম জানাবে!!
কুমিল্লা পৌঁছে বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসে উঠলেন। সন্ধ্যার পর আমরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি একে একে প্রত্যেকের নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমাদের এক কর্মীÑ তার নাম বলল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পরবর্তীতে বাখরাবাদ গ্যাস এর ম্যানেজার)। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না আজ থেকে তোর নাম মোহাম্মদ আলী বিপ্লব।’ পরের দিন সকাল ৯টা কি ১০টার দিকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন, আমি ও রুস্তম আলী ছাত্রলীগের পতাকা উত্তোলন করলাম। অভিবাদন মঞ্চে আমরা দুজন বঙ্গবন্ধুর দুপাশে দাঁড়ালাম। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘মনে রাখবা অনেক রক্তের বিনিমিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তোমরা লেখাপড়া করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গড়ার কাজে, গরীব মানুষের সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করবে।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন দুপুরে কুমিল্লার নুরপুর হাউজিং এস্টেট এর মাঠে স্মরণাতীত কালের বিরাট জনসভায় মূল্যবান ভাষণ দেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেল উদ্বোধন ও জনসভা উপলক্ষে দাউদকান্দি আসেন। তিনি হেলিকপ্টারে গোমতীর অপর পাড়ে অবতরণ করে স্পীড বোট যোগে এ পাড়ে আসেন। ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নদীর পাড়ে তাঁকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সালাম জানায়। ফেরী ঘাটে অভিবাদন আনুষ্ঠানিকতার পর তিনি হেঁটে মোটেল উদ্বোধন করতে আসেন।
কুমিল্লা শহর আওয়ামীলীগের প্রাক্তন সভাপতি এবং ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস এডভোকেট রুস্তম আলী বলেন, মুরাদনগরে একটি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে দুর্গত-অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে এসেছিলেন। ওখানে তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়। তাঁকে আমি প্রথম থেকেই ‘লিডার’ বলে ডাকতাম। আমি ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস ছিলাম। ভিপি ছিলেন নাজমুল হাসান পাখী। এ নির্বাচনে ছাত্র সংসদের ১৬/১৭ টি পদের মধ্যে ছাত্রলীগ ১৫টি পদে নির্বাচিত হয়। এ নির্বাচনে শিরিন বানু মিতিল সাহিত্য সম্পাদক ও মৃণাল মজুমদার বহিঃক্রীড়া সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এসেছিলেন। টাউন হল মাঠে বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। ভাষণের শেষ পর্যায়ে আমাকে ও পাখীকে দুই হাতে উঁচিতে ধরে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর স্বাধীনতার আগে আর বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আসেননি। এর কারণও আছে। কুমিল্লায় আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক অবস্থা তখন খুব ভালো ছিল। কুমিল্লায় এ নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী।’
এডভোকেট রুস্তম আলী বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পাবার পর থেকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাঁর ধানমন্ডির বাসায় বহুবার গিয়েছি। ১৯৭০ সালের প্রথম পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মুরাদনগরে এক নির্বাচনী জনসভায় যোগদান করেন। আমরাও মুরাদনগর যাই। আমার সাথে জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক আছমত আলী, বুড়িচং এর চেয়ারম্যান আবুল বাসার, সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জীপ গাড়িতে করে মুরাদনগর যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আমাদের দেখে মোস্তফা ভাইকে ছোঁ মেরে জীপে তুলে নিয়ে যান। সভার পর নোয়াখালী যাওয়ার আগে এডভোকেট আহমেদ আলীর বাসায় যান। আছমত আলী ও চেয়ারম্যান আবুল বাসারকে সাংগঠনিক কাজের জন্য এডভোকেট আহমেদ আলীর মাধ্যমে টাকা দিয়ে যান।’
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লায় শেষবারের মতো আসেন ১৯৭২ সালের ৪ জুলাই। তখন তিনি বাংলদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটাই ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ আগমন। তিনি পুলিশ লাইনে অভিবাদন গ্রহণ করেন। স্থান সংকুলানের কথা চিন্তা করে কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগ প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নূরপুর হাউজিং এস্টেটে এক জনসভার আয়োজন করে। মঞ্চ তৈরি হয় কেটিসিসিএ লিঃ এর সামনে। বিশাল মঞ্চ।
(‘কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শিরোনামে আমার একটি গ্রন্থ রয়েছে। ওই গ্রন্থে আলোচ্যবিষয়ে বিস্তারিত তথ্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে।)

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।