শীতেরে কইও আঁর খাঁতা কাবড় নাই!

।। তৈয়বুর রহমান সোহেল ।।
শৈশবে রোজার ঈদের চেয়ে কুরবানির ঈদে মজা হতো বেশি। আশুগঞ্জ থেকে ছোট কাকারা সপরিবারে আসবেন। সমবয়সী চাচাতো ভাই শরীফ আসবে, কত আনন্দ হবে, সে চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে যেতো। ঈদের সপ্তাহখানেক বা দু’চারদিন আগে তারা আসতো। বাড়ি ভরে উঠতো আনন্দ-কোলাহলে। আব্বু কর্মজীবনের অর্ধেক কাটিয়েছেন পুলিশে, বাকি অর্ধেক সৌদি আরবে। আব্বু সৌদি আরব যাওয়ার পর আমার জন্ম। জীবনের প্রথম তেরো বছরে আব্বুর সান্নিধ্য পেয়েছি এক-দেড় মাস। অবশ্য জীবনের এ সময়টাতে তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আব্বু কাছে থাকলে হয়তো বাড়তি আনন্দ যোগ হতো, কিন্তু যেহেতু তাকে কাছে পাইনি সেহেতু এ বিষয়ে মন্তব্য করাটা একটু কঠিনই। ২০০১ সালে দাদার মৃত্যু আর বড় বোনের বিয়ের পর বাড়িতে দাদিসহ বাকিরা সবাই ছিল। মামাদের বাড়ি আশেপাশে থাকায় আব্বুর অনুপস্থিতি খুব একটা টের পেতাম না। তার ওপর নিতান্তই শিশু। দুঃখ-যাতনা নেই, পাপ-পুণ্যের হিসেব নেই, কোনও লক্ষ্যবস্তু নেই- শুধু বল্গাহরিণের মতো ছুটে বেড়ানো। পৌষের চাঁদনি রাতে পাতায় পাতায় লুকিয়ে খেলা করা, শিশিরভেজা রাতে কখনও বাউলা খেত মাড়িয়ে বেড়ানোর মাঝে ছিল পরম তৃপ্তি। খুব ছোট থাকতে গাছে উঠতে ভয় পেতাম। বাড়ির আশেপাশে প্রায় সবগুলো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করতেন ছোট মামা। দিনের বেলা গাছে কলসি বাঁধা হতো না। খুব সকালে ডাঙুলি আর গোল্লাছুট খেলে সবাই গাছে উঠে জিহ্বা বের করে রস পান করতো। আর আমি বেচারা গাছের নিচে হা করে জিহ্বাটা বের করে রাখতাম! ওরা কিছুটা চতুর হওয়ায় রাতেও খেজুরের রস চুরির অভিযানে নামতো। দিনে সবাই মিলে মজা করে পায়েস বানিয়ে খেতো। ঈদ ঘনিয়ে আসলে জমজমাট হয়ে উঠতো গরু বাজার। আমরা দুই বাজারকে টার্গেট করতাম। বটতলী ও জোড্ডা বাজারের বাইরে অন্য কোথাও গরু কেনার রেকর্ড ছিল না বললেই চলে। দল বেঁধে সবাই বাজারে যেতাম। পুরো বাজারে ঘোরাঘুরি করে দাম জিজ্ঞেস করা, গলায় হার আর রং মাখা বড়বড় গরু দেখে বেশ আনন্দ হতো। গরু কেনার পর বাড়িতে আনা আর গরুর যতœ নেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের ছোটদের ওপর। গরু নিয়ে বেশি কষ্ট করতে হতো সহোদর শাহিনকে। ঘাসকাটা, গরু চরানো, খেয়াল রাখার গুরুদায়িত্ব ছিল তার। গরু কেনার প্রধান দায়িত্বে ছিলেন জেঠা, যা এখনো বদলায়নি। কোরবানির ঈদে গরু জবাইসহ কাজ বেশি থাকায় খুব সকালে ঈদের জামাত হতো৷ শীতের তীব্র ঠান্ডা উপেক্ষা করে সবাই চলে যেতাম মামাদের পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে। সূর্যের মোলায়েম আলোতে সবাই মিলে ঝাঁপ দিতাম পুকুরে। আর সমস্বরে বলে উঠতাম, ‘শীত মিত ভাই, শীতেরে কইও আঁর খাঁতা কাবড় নাই……!’

লেখক:সাংবাদিক।