করোনা, কুরবানি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
।। জয়নাল আবেদিন রনি ।।
যখন আমি শুনি,” প্লিজ গরুর মাংস বেশি খাবেন না, তাহলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ” তখন আমার মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের একটি সংলাপের কথা মনে পড়ে। কথাটি হল, “ঈশ্বর থাকেন, ঐ গ্রামে,ভদ্র পল্লীতে -এখানে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।” সরকারি হিসাবমতে একজন মানুষের দৈনিক ২১২২ ক্যালোরি খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা প্রয়োজন। তা নাহলে তাদেরকে দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এখনো বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এই পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণে অক্ষম। কাজেই অতি উচ্চ মূল্যের গরুর মাংস খেলে অনেক রোগের ঝুঁকি থাকবে, এমন কথা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই বড় তিক্ত কথা। এসব কথা উপরতলার মানুষের জন্য মানানসই; সবার জন্য না। কারণ এত উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে সাধারণ মানুষ বেশিতো দূরের কথা প্রয়োজনটুকুও মেটাতে পারে না। তাই উপন্যাসের মতই মুচকি হেসে বলতে হয়, এসব উপদেশ এ পাড়ায় নয়, অন্য পাড়ায় বলুন। আমরা এতদিনে নিশ্চয় জানি, করোনা ঠেকাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রোটিনের কত প্রয়োজন। গরুর মাংস প্রোটিনের একটি বড় উৎস। অথচ তা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার একদম বাইরে। শুধুমাত্র এই কুরবানি উপলক্ষেই মানুষজন ধর্মীয় কারণে উপহার হিসেবে গরুর মাংস পায়। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের প্রায় সকলেই স্বাচ্ছন্দ্যে গরুর মাংস বিতরণ করে গরীবদের মধ্যে। কাজেই, এই উৎসব ধর্মীয় কারণে উদযাপিত হলেও তা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। বিনিময়ে সারা বছরে এই একবার একটু ভাল খাওয়ার সুযোগ হয় শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি গরীব আত্মীয় স্বজনদের। কুরবানির বিধিবিধানকে অবজ্ঞা করে অনেককে আবার বলতে শুনেছি, এতগুলো অবলা প্রাণিদের এভাবে হত্যা করা নিষ্ঠুরতা। তাদের খেয়াল রাখা উচিৎ, মাছও একটা প্রাণী। অথচ প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ আমরা হত্যা করে খাই, সেসব নিয়ে তাদের কোনো কথা বলতে শুনা যায় না। এর মানে কি গরুর বিষয়টা শুধু ধর্মীয় উৎসবের সাথে জড়িত বলেই তাদের এত মাথা ব্যথা! কুরবানি মানুষকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। আল্লাহকে খুশি করতে ধনী ব্যক্তিদের এই ত্যাগের স্পর্শ কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক চাকাকেও গতিশীল করে। বিশ্ব বাজারে আমাদের দেশের চামড়া শিল্পের আজকের এই উর্ধ্বমুখী অবস্থানের পিছনে কুরবানির উৎসবেরই রয়েছে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। এই মৌসুমেই সস্তায় চামড়া সংগ্রহ করা হয় বলেই চামড়া শিল্পে কাঁচামালের কমতি হয়না। একটি বিশেষ গোষ্ঠী যাদের আমরা ঋষি হিসেবে চিনি তার কাঁচা চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত। কাজেই আমাদের কুরবানি এখন শুধুমাত্র একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই,বরং তা মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরেও ভিন্ন ধর্মীদেরও রুটি রুজির যোগান দিচ্ছে। আমাদের দেশের বেকার সমস্যা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। গরুর ফার্ম হতে পারে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সুলক্ষণ। নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরো কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এই দুঃসময়ে অনেক বড় বিষয়। গরুর দুগ্ধজাত পণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ আমাদের দেশের বাজার বৈষম্যকে রাতারাতি কমিয়ে আনবে। প্রাণিজ প্রোটিনের যে চাহিদা তা মেটাতে তখন আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। উচ্চ শিক্ষিত তরুণ বা তরুণীরা ইন্টারনেটের এই যুগে নিজেরাই বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে পারে খুব সহজেই। করোনাতংকে এবার তো অনলাইনেও গরু কেনাবেচা হচ্ছে। মোদ্দাকথা, জীবন নামের সাইকেলটা আমাদের চালাতেই হবে সে যত ঝড়ই আসুক না কেন। কুরবানি ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর জন্যও একটি বড় আর্শিবাদ। এই উপলক্ষে ডিপ ফ্রিজ বিক্রির হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তাহলে বুঝাই গেল গরুর মত নিরীহ গোছের গৃহস্থালি পশুর কুরবানি উপলক্ষে এ উৎসর্গের প্রভাব ছুঁয়ে দিয়েছে আধুনিক যুগের ইলেকট্রনিকসকেও। হারহামেশাই টিভিতে দেখা যায় এই উপলক্ষে গরুর মাংসের বিভিন্ন রেসিপি নিয়ে রান্নার অনুষ্ঠান। কাজেই বিনোদন মাধ্যমকেও প্রভাবিত করার একটি বড় ধরনের প্রয়াস রয়েছে কুরবানির গরুর। করোনা আমাদের সবার জন্যই হুমকি। কিন্তু আতংক, রাগ ঘৃণা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু কেউ যখন আনন্দে থাকে, তখন শরীরে এমনসব হরমোন কাজ করে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। তাই আসুন, আমরা কুরবানি ঈদের আনন্দ সচেতনতার সাথে উপভোগ করি,পরস্পরকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই। অর্থনীতিকেও এগিয়ে রাখতে যথাযথ ভূমিকা নেই। সবশেষে একটি মজার তথ্য মনে করিয়ে দেই, কুরবানির চামড়া বিক্রি হবার পরে সেই চামড়ায় কিন্তু লিখা থাকেনা, কোনটা কুরবানির কোনটা সাধারণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে জবাই করা। চামড়া দিয়ে যেমন জুতা তৈরি হয়, তেমনি ঢোলও তৈরি হয়। ভাবুন তো! কুরবানির চামড়া কখনো কখনো ঢোলেও বাজছে। এ কারণেই বাংলাদেশ অনন্য। আর আমরা গর্বিত আমরা এমন চমৎকার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নাগরিক বলে।
লেখক:ব্যাংক কর্মকর্তা।