আমোদ পরিবারের উপর থেকে ছাদ সরে গেলো

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল:
সেদিন থেকেই কুমিল্লা শহরে সাংবাদিকতায় একজন অভিভাবকের শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম, যেদিন আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বী ভাই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর কথা জানালেন। গল্পের শুরুটা তারও ১৬ বছর আগের। একজন পেশাদার চিত্রকর আর সখের আলোকচিত্রির মাঝে লেখালেখিরও একটা নেশা জেগে বসেছিলো আমার। সেটি ১১৯৯৬ সালের দিকে কথা। বন্ধু আবু মুহাম্মদ রাশেদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে শুরু করলাম। প্রথম লিখাটি ছাপা হলো ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক সুকন্যা পত্রিকায়। আহা কি আনন্দ! সেই থেকে বিভিন্ন মাসিক-সাপ্তাহিক-দৈনিকের উন্মুক্ত বিভাগে অনিয়মিত লিখা প্রকাশ হতে লাগলো। চিত্রকর-আলোকচিত্রি-শিক্ষানবিশ লেখক তিনটি নেশাই সমান্তরাল চলতে লাগলো!
২০০০ সালের দিকে এসে মাথায় ভুত চাপে সাংবাদিকতার। এই সময়ের মধ্যে অনেক স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকার সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় হতে থাকে মতিঝিল-ফকিরাপুল-আরামগাগের অনেক অখ্যাত পত্রিকা অফিসের সাথেও। তখনো জানতাম না পত্রিকা জগতে আন্ডারগ্রাউন্ড বলতে একটা কথা প্রচলিত আছে!
১৯৯৬-২০০২ সাল। মাঝখানে অর্ধযুগ। ২০০২ সালে আমার এলাকার এক হোমিও চিকিৎসক হায়দরাবাদ কলেজের প্রভাষক জহির উদ্দিন বাবর স্যারের সাথে পরিচয়। বাবর স্যার আমোদ-এ লিখেন একই কলেজের প্রভাষক মমিন মোল্লার সাথে। তিনি জানতেন আমিও লিখি। আমাকে প্রস্তাব করলেন আমোদ-এ কাজ করতে।
গ্রামের ছেলে বলে কথা। তখনও আমোদ নামটির সাথে আমার পরিচয় হয়ে উঠেনি। তাদের দুজনের অনুপ্রেরণায় লিখা পাঠালাম। ছাপা হলো। সেই থেকে সবকিছুর নেশা ছেড়ে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করতে লাগলাম। কিন্তু দিন যতোই যাচ্ছে মনের মাঝে একটা প্রশ্ন জাগছে- যেখানেই লিখা পাঠাই অবিকল ছাপা হয়ে যায়; অথচ সাধারণত কুমিল্লার একটা সাদাকালো পত্রিকায় আমার সব লিখা ছাপা হয় না! আর ছাপলেও অনেক কাটাছেড়া (সম্পাদনা) করে তবেই ছাপা হয়!
কোনো এক বুধবার সাহস করে আমোদ অফিসে চলে যাই। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বীসহ পরিচয় হয় পত্রিকাটির স্টাফ রাইটার শাহাজাদা এমরান, মামুন সিদ্দিকী এবং মহিউদ্দিন মোল্লার সাথে। কিছুক্ষণ পর ভেতরের রুম থেকে মাথায় ঘোমটা দেয়া গায়ে স্কার্ফ পরা অত্যন্ত পর্দানশীল একজন ভদ্র মহিলা পত্রিকার সম্পাদকের রুমে এলেন। প্রথমেই সবার বিকেলের নাস্তা হয়েছে কি-না খোঁজ খবর নিলেন। এরপর তিনি বিশেষ কি সংবাদ আছে খোঁজ নিলেন। আমি পাশ থেকে নীরব দর্শক হয়ে দেখছিলাম। বুঝতে পারলাম, তিনিই আমোদ এর উপদেষ্টা সম্পাদক শামসুননাহার রাব্বী।
অত্যন্ত শুদ্ধ ভাষায় কতো চমৎকার করে কথা বলছেন! যেন প্রতিটি কথায় মধ্যে আন্তরিকতা লুকিয়ে আছে! একপর্যায়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি কে? বাকীন ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন- আম্মা; সে-ই ইমরুল, আমাদের মুরাদনগর সংবাদদাতা। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তিনি আমার পুরো নাম জানতে চেয়ে বললেন, ‘তোমার লিখার হাত বেশ ভালো। আমি তোমার লিখাগুলো পড়ি।’ অনেক কথা হয় হয় সেদিন। তিনি আমাকে দোয়া করলেন এবং অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখতে বললেন। সেদিনই লক্ষ্য করলাম এটি শুধু একটি পত্রিকা অফিস নয়; এযেন স্নেহভরা একটি পরিবার।
চলতে থাকলো আমোদ-এর সাথে আমার পথচলা। এই পথচলায় বহুবার যাতায়ত হয় আমোদ-এ। দেখা হয়, কথা হয় মহিয়সী নারী শামসুননাহার রাব্বীর সাথে। এই পথ চলায় আমি বুঝতে পারি একজন আদর্শবান সাংবাদিক ফজলে রাব্বীর গড়া আমোদ একটি পত্রিকাই নয়, নিয়ম-শৃঙ্খলার নাম আমোদ। এখানে শুধু সংবাদ প্রকাশই হয় না, আদর্শ-নিয়মানুবর্তিতা-জবাবদিহিতা-দায়িত্বশীলতা অনেক কিছুই শেখার আছে এখান থেকে।
আমি আমোদ সম্পাদক মোহাম্মাদ ফজলে রাব্বীকে দেখিনি। তবে শামসুননাহার রাব্বীর মাঝেই দেখেছি একজন ফজলে রাব্বীকে। আশির দশকে স্বামীর দেয়া এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে যেভাবে দক্ষতার সাথে হাল ধরেছিলেন। স্বামীর অবর্তমানেও নানান প্রতিকূলতা সামলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন একেবারেই স্বামীর দেখানো পথেই। একজন নারী কতোটা বিচক্ষণ আর দূরদর্শী হলেই তা সম্ভব শামসুননাহার রাব্বীই তার উদাহরণ।
২০১১ সালের শুরুর দিকের কথা। আমার সাংবাদিকতার তখন একদশক চলছে। কুমিল্লার সাংবাদিকতায় একেবারেই নবীন আমি। মুরাদনগর থেকে কুমিল্লায় উত্তীর্ণ হয়ে পত্রিকা থেকে টিভি সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছি মাত্র। তবে আমোদের কাজ চলছে সমান তালেই। বরং ততোদিনে আমোদ আমার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে আশ্রয় স্থলে। প্রচ্ছন্ন ভাবে কুমিল্লায় আমার অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন বাকীন রাব্বী-শামসুননাহার রাব্বী।
একদিন বাকীন রাব্বী ভাই জানালেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে যাচ্ছেন। শুনেই মনটা বিষাদে ভরে উঠলো! প্রায় এক দশকের চেনায় মানুষটিকে যতোদূর বুঝতে পেরেছিলাম, ওনি এক কথার মানুষ; অনেক ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি যা সিদ্ধান্ত নেন তাতে অনড় থাকেন। সবকিছু জেনেও অনেকভাবে বুঝাতে লাগলাম যাতে দেশেই থেকে যান। প্রতিনিয়তই নানান আবেগী কথা লিখে মেইল করতে থাকি। যেকোনো কারণেই হোক সেযাত্রা বাকীন ভাইয়ের সিদ্ধান্ত পাল্টান। কিন্তু পরেরবার সিদ্ধান্তটা এতোটাই পাকাপোক্ত ছিলো যে তাকে ঠেকানোর সাধ্য কার? তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েই ছাড়লেন। মনো হলো মাথার উপড় থেকে যেন আস্ত একটা ছাদ সরে গেছে!
সেদিনতো শুধু আমার মাথা থেকে ছাদ সরেছিলো। এবারতো আমোদ পরিবারের উপর থেকেই ছাদ সরে গেলো চিরতরে। আমোদ নৌকায় ফজলে রাব্বীর নিযুক্ত সেই দক্ষ মাঝি শামসুননাহার রাব্বীর মহা প্রয়াণের মধ্য দিয়ে!

লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি,মাছরাঙা টিভি।