বেকারের জীবনডাটা: এক প্রজন্মের দাফনের আগেই মৃত্যু

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
দেয়ালে আঁকা একটি ছবি। এক তরুণ বসে আছে, দৃষ্টিহীন চাহনি, মুখহীন আকৃতি। পাশে লেখা—“বেকারের জীবনডাটা”।
এ দৃশ্যটি যেন কেবল একটি দেয়ালচিত্র নয়, এটি এক নীরব চিৎকার, একটি প্রজন্মের গুমরে ওঠা ইতিহাস। এটি আমাদের রাষ্ট্রের—আরও স্পষ্ট করে বললে—আমাদের ব্যর্থতার দলিল।
বাংলাদেশ আজ গর্ব করে বলে, আমরা উন্নয়নশীল দেশ। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, ডিজিটাল পরিষেবা—সবই দৃশ্যমান। অথচ এর আড়ালে এক ভয়াবহ বাস্তবতা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে—বেকার সমস্যা, যা আর কেবল একটি অর্থনৈতিক ইস্যু নয়; এটি এক সামাজিক-মানসিক মহাসঙ্কট।
পরিসংখ্যানের নির্মমতাঃ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর ২০২৪ সালের শেষ ত্রৈমাসিক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২৭ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ৪০ হাজার এবং নারী ৮ লাখ ৫০ হাজার।
যে দেশে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী স্নাতক হয়ে বের হয়, সেখানে অধিকাংশই কর্মসংস্থানের কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে হতাশায় ডুবে যায়। উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরির আশায় ঘুরতে থাকা এ বেকার তরুণ-তরুণীরা শুধুই পরিসংখ্যান নয়, তারা প্রত্যেকেই এক একটি অসমাপ্ত স্বপ্নের নাম।
বেকার মানেই শুধুই কাজ না থাকা নয়ঃ
বেকার মানে হচ্ছে—নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবা। বেকার মানে—নিজ পরিবারে বোঝা হয়ে যাওয়া। বেকার মানে—প্রতিটি সকাল শুরু হয় হতাশা দিয়ে, আর রাত শেষ হয় অশ্রুজলে।
এ সমাজে বেকারত্ব যেন এক সামাজিক লাঞ্ছনা। আত্মীয়-স্বজনের চোখের কটাক্ষ, প্রতিবেশীর চাপা প্রশ্ন, পরিবারে গুমোট নীরবতা—এসব মিলিয়ে একটি তরুণ-তরুণীর আত্মবিশ্বাস ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
শিক্ষা কি শুধুই ডিগ্রি বিক্রির বাজার?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি সত্যিই জীবনের জন্য প্রস্তুত করছে? নাকি এটি হয়ে উঠেছে একটি ‘বেকার তৈরি কারখানা’?
চার-পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ডিগ্রি অর্জনের পর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তারা দেখে, এ ডিগ্রির কোনো বাজারমূল্য নেই। নেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা, নেই হাতে-কলমে শিক্ষা। শুধু সার্টিফিকেট আর প্রত্যাখ্যানের চিঠি!
সমস্যার মূল ও পথের সন্ধানঃ
১. শিক্ষা ও বাস্তব দক্ষতার মিল না থাকা
২. সরকারি চাকরির সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতি
৩. বেসরকারি খাতে শোষণমূলক পরিবেশ
৪. উদ্যোক্তা সৃষ্টির উপযোগী অবকাঠামোর অভাব
এ সমস্যাগুলোর কোনো একটি সমাধান করলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটি সর্বব্যাপী ও সমন্বিত উদ্যোগ।
সম্ভব সমাধান এক সপ্তাহেই—যদি রাষ্ট্র চায়!
রাষ্ট্র যদি আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেয়, তবে এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন নেই। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষেও এ কাজ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে।
যেমন: প্রতিটি জেলায় কর্মসংস্থান সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, কারিগরি ও ডিজিটাল স্কিল ট্রেনিং চালু, বিনিয়োগ ও স্টার্টআপ ফান্ড তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উৎপাদন খাতে অনুদানভিত্তিক কর্মসংস্থান, এভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মাধ্যমে বেকার সমস্যার বাস্তব সমাধান সম্ভব।
নজিরবিহীন ইতিহাস হতে পারে বর্তমান সরকারঃ
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য বিমোচনে যেমন ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ গড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি বেকার সমস্যা সমাধানে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়, তবে তা হবে এক “মানবিক বিপ্লব”। এ উদ্যোগ কেবল রাজনৈতিক অর্জন হবে না, এটি হবে এক জাতির আত্মমর্যাদা পুনর্গঠনের অধ্যায়।
বেকারের জীবনডাটা: দাফনের আগেই মৃত্যু
ছবিতে যে তরুণটি দেয়ালে বসে আছে, সে আমরা সবাই। সে আমার ভাই, আপনার মেয়ে, আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের জাতি।
তার চোখে নেই আলো, তার ভবিষ্যতে নেই দিশা। তার একটাই দাবি—“আমিও বাঁচতে চাই, আমারও কিছু হোক”।
তাই রাষ্ট্রকে আজ উত্তর দিতে হবে-
“শুধু উন্নয়নের গল্প নয়, কর্মসংস্থানের গল্প কবে আসবে?” “কেবল ভবিষ্যৎ চিন্তা নয়, বর্তমানের বুকফাটা আর্তনাদ কি আপনি শুনছেন?”
বেকার সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক নীতি দিয়ে মাপা যাবে না, এটি এক মানবিক ইস্যু।
এ সমস্যার সমাধান মানেই—একটি প্রজন্মকে বাঁচিয়ে দেওয়া। আর এ বাঁচিয়ে দেওয়া—ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কর্ম হবে।
আরো পড়ুন