জীবন ও গণিত: সমীকরণ যেখানে থেমে যায়


মনোয়ার হোসেন রতন।।
“পৃথিবীর সব অঙ্কের সমাধান মেলে, কিন্তু জীবনের অঙ্ক আজও অমীমাংসিত।”
এ বাক্যটি আমি বারবার হৃদয়ে অনুভব করি। কারণ আমি নিজেই ছাত্রজীবনে গণিতে খুব একটা পারদর্শী ছিলাম না। সংখ্যার প্রতি আমার ভীতি ছিল, সূত্রের গোলক ধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলতাম বারবার। অথচ, আজ যখন জীবনের পথে কিছুটা এগিয়েছি, তখন বুঝি—সবচেয়ে দুর্বোধ্য, জটিল ও ধাঁধাময় বিষয়টি আসলে এ ‘জীবন’ নিজেই।
গণিত এক বিশুদ্ধ শাস্ত্র। যেখানে সবকিছু গাণিতিক যুক্তি, নিয়ম, সূত্র আর ধ্রুবকের মধ্যেই আবদ্ধ। সেখানে এক প্লাস এক, কখনোই তিন হয় না। পৃথিবীর জ্ঞানবৃন্দ—পিথাগোরাস, ইউক্লিড, গাউস, আর্কিমিডিস, নিউটন, র্যামানুজান কিংবা বর্তমান যুগের টেরেন্স টাও পর্যন্ত—সত্যিই অসাধারণ মেধা দিয়ে অঙ্কের জটিল জট খুলে দিয়েছেন। তাঁদের হাতে জন্ম নিয়েছে কাল্পনিক সংখ্যা, চতুর্থ মাত্রা, ইনফিনিটি থিওরি, বিগ ডেটা অ্যালগরিদম, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং—যা আমাদের নিয়ে গেছে গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ থেকে শুরু করে মাইক্রোচিপের ক্ষুদ্র জগতে।
তবু বলছি, এতসব জ্ঞান আর বিশ্লেষণের পরেও, জীবনের সমীকরণ আজও অস্পষ্ট।
জীবন সেই পাঠ যেখানে পূর্বশর্ত থাকলেও ফলাফল অনির্ধারিত। কেউ নিয়ম মেনে চলে, তবুও হেরে যায়। কেউ সব সূত্র ভেঙে এগোয়, তবুও জয়ী হয়। এখানে প্রতিদিন নতুন এক অঙ্ক হাজির হয়, কিন্তু তার কোনো পূর্বনির্ধারিত সূত্র নেই। জীবন নামক এ শাস্ত্রে অনেক সময় শূন্যই সবচেয়ে বেশি ব্যথা দেয়। কখনো মনে হয় জীবন চলে সম্ভাব্যতা (Probability)-র ভিত্তিতে, কখনো অনুমান (Assumption), আবার কখনো চলে অনিশ্চয়তা ও অবচেতনের এক জটিল গাণিতিক পথে, যার কোনও ঠিকানা নেই।
আমরা তো ছোটবেলা থেকেই শিখি—যা পরিমাপযোগ্য, সেটিই গ্রহণযোগ্য। লর্ড কেলভিনও এক সময় বলেছিলেন, “If you cannot measure it, you cannot improve it.” কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভালোবাসা, মায়া, হতাশা, প্রত্যাশা—এসব কিভাবে মাপবো? জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান গুলোই তো পরিমাপযোগ্য নয়।
আমি প্রায়শ ভাবি—জন ন্যাশের কথা। সেই গেম থিওরির জনক, যার বুদ্ধিমত্তা এবং গাণিতিক নৈপুণ্য তাঁকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার। অথচ এ মানুষটিকেই জীবন ঠেলে দেয় মানসিক রোগের অন্ধকার গহ্বরে। গণিত তাঁকে গর্বিত করেছিল, কিন্তু জীবন তাঁকে কাঁদিয়েছিল।
আর এটাই আমাদের প্রত্যেকের বাস্তবতা—
কোনো সূত্রে বাঁধা যায় না মায়ের চোখের অশ্রু, কোনো উপপাদ্য দিয়ে বোঝা যায় না, প্রিয়জন কেন দূরে সরে যায়।
আমরা কত তথ্য, উপাত্ত, বিশ্লেষণ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু বাস্তবে, এক মুহূর্তের আবেগ, এক ফোঁটা অশ্রু, কিংবা একটি ভুল বোঝাবুঝি সমস্ত অঙ্ক উল্টে দিতে পারে। জীবনের এ অনির্ধারিততা, এ অসমিকরণই বারবার বলে—তুমি যতই গাণিতিক হোও, হৃদয়ের প্রশ্নের উত্তর একমাত্র হৃদয়ই দিতে পারে।
জীবন নিজেই এক চলক (Variable)। এর কোনো নির্দিষ্ট মান নেই, নেই নির্দিষ্ট গতি। এটি কখনো রৈখিক, কখনো বিশৃঙ্খল। ইচ্ছা আর নিয়তির মাঝে প্রতিনিয়ত এক সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা। তুমি যতই সূত্র ধরো, যদি জীবনের অপর পাশে মানুষ না থাকে, মমতা না থাকে, তাহলে সেই অঙ্ক মিলবে না কখনো।
জীবনের এ অপার চলকে সবচেয়ে বড় সূত্র যদি কিছু থাকে, তবে সেটি হলো – ভালোবাসা, সহানুভূতি, বিশ্বাস ও ক্ষমা। এ চারটি উপাদান একত্রে না এলে জীবনের গণিত বুঝে ওঠা যায় না।
আমার মনে হয়, আমাদের উচিত—গণিতের মতোই ধৈর্য নিয়ে জীবনের অঙ্ক বুঝতে শেখা। ভুল করলে সংশোধন, শিখলে প্রয়োগ, ব্যর্থ হলে পুনরায় চেষ্টা—এ চক্রেই হয়তো জীবনের উত্তর লুকিয়ে আছে।
বন্ধুরা, চাঁদে পৌঁছানোর ফর্মুলা আমরা পেয়েছি গণিতে, কিন্তু ‘কেন আমরা কাঁদি’, ‘কেন কাউকে হারিয়ে জীবন থমকে যায়’, ‘কেন সবকিছু থাকার পরও হৃদয়ে শুনশান নীরবতা’—এসব প্রশ্নের উত্তর নেই কোনো অ্যালগরিদমে।
তবুও আমি আশাবাদী। হয়তো একদিন কোনো মহান পণ্ডিত জীবনের এ অমীমাংসিত অঙ্কটিও মেলাতে পারবেন। কিন্তু তার আগে আমাদের শিখতে হবে—জীবনকে যুক্তির নয়, অনুভূতির ভাষায় পড়তে। সূত্র নয়, স্পর্শে বুঝতে।
এটাই জীবন ও গণিতের সবচেয়ে বড় পার্থক্য।
এটাই জীবন ও গণিতের সবচেয়ে বড় পার্থক্য।