আলোচনায় কুমিল্লার ৫প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন

বাহার উদ্দিন খান।।
শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু রাখা এবং ছাত্র রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে কলেজ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক যোগ্য নেতৃত্ব গঠনের জন্য কার্যকর ছাত্র সংসদ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। যখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে, তখন কুমিল্লার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ এবং বেসরকারি ভাষা সৈনিক অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ে কার্যকর ছাত্র সংসদ গঠনের জোর দাবি তুলেছেন শিক্ষার্থীরা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
তাদের দাবি, কার্যকর ছাত্র সংসদ থাকলে নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হতো, বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ কমতো, ক্যাম্পাসে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকতো এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরাসরি নিজ নিজ সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেতেন। এছাড়া, গণতান্ত্রিক চর্চার একটি ভিত্তি গড়ে উঠতো।
তবে কিছু ছাত্র নেতা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত, প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাও সমান জরুরি।
এদিকে কলেজগুলোর প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ছাত্র সংসদ খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেওয়া হলেও কার্যকর ছাত্র সংসদ না থাকায় সেই টাকা বছরের পর বছর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তবে নতুন সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, কার্যক্রম না থাকলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না এই কারণে চলতি বছর থেকে ওই খাতে আর কোনো অর্থ নেওয়া হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকেও নেই ছাত্র সংসদ
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ইতোমধ্যে বিশ বছর পেরোলেও এখনও গঠিত হয়নি কোনো ছাত্র সংসদ। যদিও শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত ২৯ জুলাই ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করিমকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি গঠন করেছে।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ওবায়দুল্লাহ খান বলেন, “বিশ বছরেও একটি ছাত্র সংসদ না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও নেতৃত্ব বিকাশে এটি এখন খুবই জরুরি।”
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করিম বলেন, “ছাত্র সংসদ গঠনে আইনগত দিক, ছাত্র সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ, বাজেট ও ইউজিসির অনুমোদনসহ সব কিছু বিবেচনা করে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে।”
তিন দশক ধরে বন্ধ ভিক্টোরিয়ায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ সংবিধানের ৬৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রতি বছর জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালের ২০ মে। ওই নির্বাচনে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের যৌথ প্যানেল থেকে ছাত্রদলের আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম ভিপি এবং ছাত্রশিবিরের সানাউল্লাহ মজুমদার জিএস নির্বাচিত হন।
বর্তমানে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বলেন, “নিয়মিত নির্বাচন হলে ভালো হতো। তবে বর্তমানে জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় এই মুহূর্তে কলেজে নির্বাচন দিলে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে।”
এদিকে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক ৯ দফা দাবির মধ্যেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান কাউসার বলেন, “তিন দশক ধরে ছাত্র সংসদ নেই। এখন অনুকূল পরিবেশে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছি।”
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবুল বাশার ভূঁইয়া বলেন, “এই বছর থেকে আর ছাত্র সংসদ খাতে টাকা নেওয়া হচ্ছে না। আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অনেকগুলো পক্ষ জড়িত। শিক্ষার্থীরা যেহেতু চাইছে, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করব।”
নগরীর বাকি তিন প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র সংসদ অকার্যকর
কুমিল্লা নগরীর বাকি তিন প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা সরকারি কলেজ,কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ এবং বেসরকারি ভাষা সৈনিক অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রায় তিন দশক ধরে বন্ধ। কুমিল্লা সরকারি কলেজে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালের ৩১ অক্টোবর, যেখানে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) প্যানেল থেকে কামরুল হাসান শাহিন (ভিপি) এবং আতিকুর রহমান খান পিন্টু (জিএস) নির্বাচিত হন। একই বছর কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজেও নির্বাচন হয়েছিল। সেখানে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রদলের ঝংকার এবং জিএস পদে কাজী নাজমা।
অজিত গুহ কলেজে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালে। এক বছর পর নির্বাচনকে ঘিরে কলেজ ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, যা আজও বহাল রয়েছে।
কুমিল্লা সরকারি কলেজের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, “ছাত্র সংসদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা অধিকার আদায়ের জন্য কোনও প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক চর্চা, সহনশীলতা ও মুক্ত আলোচনার পরিবেশও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
কুমিল্লা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. নূরুর রহমান খান বলেন, “ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখনও শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারব।”
অজিত গুহ কলেজের সর্বশেষ নির্বাচিত জিএস এবং বর্তমানে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হক ভূঁইয়া স্বপন বলেন, “‘ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ে এবং যোগ্য নেতা তৈরিতে অবশ্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুবই জরুরি, তবে তার আগে প্রশাসনিক সক্ষমতা যাচাই করতে হবে।”
ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন নির্বাচন জরুরি, তবে পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ
ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা মনে করেন, একটি শিক্ষার্থীবান্ধব, নেতৃত্ব তৈরি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চায় সক্ষম ক্যাম্পাস গঠনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য।
ছাত্রশিবির মহানগরের সভাপতি হাসান আহমেদ বলেন, “এই অনুকূল পরিবেশে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুবই জরুরি। কুমিল্লার সব প্রতিষ্ঠানে আমরা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।”
মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি মো. নাহিদুজ্জামান রানা বলেন, “ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ কতটুকু আছে তা বিবেচনার বিষয়। নির্বাচনের আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা জরুরি।”
এনসিপি জেলা কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, “নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। নির্বাচিত সরকারের অধীনে অনেক কিছুই প্রভাবিত হতে পারে।”
এবি পার্টি কুমিল্লা জেলা কমিটির আহ্বায়ক মিয়া মোহাম্মদ তৌফিক বলেন, “রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়ন এবং যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। না হলে মৌসুমি নেতারা বেশি গড়ে ওঠে।”