‘তোমার কিছু হলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো?’

আল-আমিন কিবরিয়া ।।
জহিরুল ইসলাম রাসেল। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীতে পুলিশের গুলি নিহত এক জুলাই যোদ্ধার নাম। শহীদ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন তিনি। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে সময় কাটান গ্রামের বাড়িতে। ছুটির দিনগুলোতে সব সময় মুখে ছিল আন্দোলনের কথা।
ছুটি শেষে রাসেল ঢাকা ফিরবে। ছাত্র জনতার সাথে অংশগ্রহণ করবে আন্দোলনে। কিন্তু স্ত্রী জান্নাত ফেরদৌসী বহুবার না করেছিলেন আন্দোলনে যেতে। কিন্তু রাসেল শুনেননি তার কথা। ফেরদৌসী তার স্বামীকে বলেছিলেন, তোমার কিছু হলে আমি আমাদের মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? কিন্তু কিছুতেই থামানো যায়নি তাকে।
রাসেল ঢাকায় ফিরে যায় ২৪ জুলাই। ঢাকায় ফিরে মাকে বলেছিলেন, চিন্তা করো না। আমি শহীদ হলে, তুমি হবে শহীদমাতা। স্বাধীন দেশে তোমরা ভালো থাকবে।
গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর সুরিটোলা প্রাইমারি স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাসেল। পরদিন রাতে বাড়ি ফিরেন লাশ হয়ে। পরিবারের ওপর যেনো নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
শহীদ জহিরুল ইসলাম রাসেলের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামে। সে ওই গ্রামের মৃত শাহ আলম সরকারের একমাত্র ছেলে ছিলেন।
রাসেলের স্ত্রী জান্নাত ফেরদৌসী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আগে মেয়েটা ছোট ছিল। কিছু বুঝত না। এখন অন্যের ঘরে কারো বাবাকে দেখলে ঘরে ফিরে এসে কান্না করে। বলে আমার আব্বু কই? আমি মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দিই না। শুধু বলি! তুমি বড় হলে তোমার আব্বু আসবে। কিন্তু আর কতদিন মেয়েকে এই মিথ্যা সান্ত¡না দেব?
রাসেলের মা মোর্শেদা বেগম বলেন, আমার একটাই পোলা আছিল। মাদরাসায় পড়ালেখা করত। তার বাপ মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে সংসার চলছিল। আমি দিনের বেলায় অন্যের বাড়িতে কাজ করতাম। রাত জেগে করতাম সেলাইয়ের কাজ। পরে ঢাকায় একটা জুতার সোল্ডার কারখানায় কাজ নেয়। একই সাথে সৈয়দপুর মাদরাসায় পড়া-লেখাও চালিয়ে যায়। অনেক আদর করে পোলারে বিয়ে দিছিলাম। একটা নাতনি হইছে। মেয়েটার বয়স যখন দুই বছর, তখনই পোলায় গুলিতে মারা গেল।
রাসেলের স্ত্রী জান্নাত ফেরদৌসী আরো বলেন, ঢাকায় গন্ডগোলের খবর পেয়ে বারবার ফোন করতাম। বলতাম আন্দোলনে যেও না। সে ভিডিও কলে আন্দোলন দেখাতো। বলত! দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরব। আমি বলতাম, তোমার একটা মেয়ে আছে। ওর কথা ভাবো। সে বলত, আমি মারা গেলে আল্লাহ ওরে দেখবে।
রাসেলের মা মোর্শেদা বেগম বলেন আরো বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর ভাবছিলাম, বউটা হয়তো চলে যাবে। কিন্তু না, সে আমার সঙ্গেই আছে। স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে। এই মেয়েটার বয়স মাত্র আঠারো/ বিশ বছর। অথচ বিধবা হয়ে গেল। ছোট্ট নাতনিটাও বাপ হারাল।

প্রত্যক্ষদর্শী চাচাতো ভাই মো. সোহেল রানা জানান, রাসেল গুলিস্তানেই চাকরি করত। গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তিনি দ্রুত গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে নেন। চিকিৎসক জানান, রাসেল পথেই মারা যান। রাসেলের ডান হাতে ও বুকে দুটি গুলি লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ওইদিন হাসপাতাল থেকে লাশ দেওয়া হয়নি। পরদিন লাশ এনে বাড়িতে দাফন করি।
দরিদ্র রাসেলের নিজেদের একটি ঘর ছিল জরাজীর্ণ, একদম বসবাসের অনুপযোগী। তারা থাকতেন চাচার ছেড়ে দেয়া একটি ঘরে। রাসেলের পরিবারকে জামায়াত ইসলামের পক্ষ থেকে নতুন একটি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মাসিক খরচ চালানোর জন্য মায়ের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে তার মেয়ের দায়িত্বও গ্রহণ করবে বলে জানায় সংগঠনটি।
সরকারিভাবে রাসেলের পরিবারকে নগদ ৫ লক্ষ টাকা এককালীন দেয়া হয়েছে। একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র করে দিয়েছে যা থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পাবেন বলে জানান তার মা।
দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসনাত খাঁন বলেন, শহীদদের পরিবারের সঙ্গে প্রশাসনের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে যে সকল সুবিধা পাওয়া গেছে, তা প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও পাশে থাকব।